ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুকের অপব্যবহার তথ্যপ্রযুক্তি অগ্রগতি ব্যাহত করছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৭ জুন ২০১৫

ফেসবুকের অপব্যবহার তথ্যপ্রযুক্তি অগ্রগতি ব্যাহত করছে

সমুদ্র হক ॥ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) প্রয়োজনীয় ব্যবহারে দেশ অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে কম্পিউটারের (বিশেষ করে ট্যাব ও ল্যাপটপ) অপব্যবহার দিনের কর্মঘণ্টার অপচয়ও হচ্ছে। জনপ্রশাসনের কাজের গতির বিঘœতাকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার রূপকল্প (ভিশন) ২০২১ এবং সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনায় আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ধনী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পথ তৈরি করেছে তার সময় আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের চলতি হাওয়ার এই সময়টায় সময় অপচয়ের সবচেয়ে বড় ফাঁদ ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। মানুষের চিন্তা চেতনা বিকাশের ক্রিয়েটিভ দিকগুলো ফেসবুকে না এসে এর এ্যাবিউজ আক্রমন করছে বেশি। সেটেলাইটের এই ভয়ঙ্কর নেশা মানুষের নিউরনের সুক্ষ্ম কোষে মনের চেয়েও কয়েক লক্ষগুণ বেশি গতিতে প্রবেশ করে দেশ মানবকল্যাণ ও উন্নয়নের সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলোর স্রোতধারায় বাঁধ দিয়ে এগোতে দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে উন্নত দেশগুলো এখন ভাবতে শুরু করেছে। তবে তারা দ্রুত নিয়ন্ত্রণও করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ফেসবুকের যথেচ্ছ ব্যবহার অনেক কমেছে। এমন কি মোবাইল ফোনের ব্যবহারও কম। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্ট ফোনের ব্যবহার নেই। সে দেশের মেধাবীরা লেখাপড়ার সময়টাকে ঠিক রেখে বাড়তি সময় বের করে সপ্তাহে দুই-একদিন নেটে যায়। জনপ্রশাসনের সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ল্যাপটপ ট্যাব ও ডেস্কটপে অফিসের কাজ ছাড়া অফিস চলাকালে কোন কাজ করে না। অবসরে পার্সোনাল কম্পিউটারে (পিসি) নিজের কাজকে এগিয়ে নেয়ার পর সময় হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক টুইটার গুগল) স্বল্প সময়ের জন্য প্রবেশ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ফেসবুকের অপব্যবহারকে ব্যক্তিত্বহীনতা বলে মনে করা হয়। সেই দেশেই (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জুকারবার্গ ও তার কয়েক বন্ধু ২ হাজার ৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যার শিক্ষকের পাঠের লেকচার বিনিময় এবং লাইব্রেরির নোট আদান প্রদানের জন্য কম্পিউটারে একটি ডিভাইজ বানায়। যাতে দূরে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে পাঠ্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া যায়। এই কাজ করতে গিয়ে তারা ডিভাইজকে উন্নত করে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি বাড়ায়। নাম দেয় ফেসবুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভারতের অনেক শিক্ষার্থী থাকায় ২ হাজার ১০ সালে তারা বন্ধু খুঁজতে ভারতের হায়দ্রাবাদে স্যাটেলাইট স্টেশন করে দক্ষিণ এশিয়াকে ফেসবুকের আওতায় আনে। তারপর... পিছনে তো আর তাকাতে হয়নি ফেসবুক তার আপন গতিকেই বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষকে টেনে এনেছে। ২০১৩ সাল থেকে ফেসবুকের উদ্ভাবকরা (সেই কয়েক বন্ধু) অনুভব করতে পেরেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের সৃষ্টির অপ্রয়োজনীয় এবং অপব্যবহারে অনেকটা ফ্রাংস্টাইন হয়ে গিয়েছে। ওই বছর থেকেই তারা ফেসবুককে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কৌশল তৈরি করে। যা অব্যাহত আছে। একাধিক বিদেশী সূত্র জানায়, ফেসবুকে অনেকেই নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ছবির ওপর কাজ করে। মধ্য বয়সী এবং বয়স্ক অনেকে নিজের তারুণ্যের ছবি দিয়ে এ্যাকাউন্ট করে। কেউ পরিচিতির অংশে ভুল তথ্য দেয়। এখন ফেসবুকে নিজের চেহারা ও পরিচয় গোপন করার সূযোগ আর থাকছে না। ফেসবুকের উদ্ভাবকরা এমন একটি সফটওয়্যার ইনস্টল করেছেন যা ছবির বিভিন্ন অংশ অটো স্ক্যান করে পরিচয় আচরণ বুঝতে পারবে। পোস্ট করা ছবিতে কারও মুখ লুকানো থাকলে সেই ব্যক্তির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পরিচয় জেনে তথ্য ভা-ারে শনাক্ত করবে। এর নাম দেয়া হয়েছে ফেসবুক ইনটেলিজেন্স ল্যাব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টেকনোলজি নিয়ে কাজ করে এই ল্যাব। ইতোমধ্যে সাইট ফ্লিকার থেকে এক লাখেরও বেশি এমন ছবি স্ক্যান করে বড় একটি অংশকে ব্লক করে দেয়া হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে ফেসবুক অপব্যবহার রোধে কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার ইতোমধ্যে রাজধানীসহ দেশের সকল জেলা ও উপজেলা একই নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে। এর আগে সরকারী সকল অফিসে কম্পিউটার ইনস্টল করা হয়। মাস কয়েক আগে প্রথম শ্রেণীর সকল কর্মকর্তাকে ট্যাব দেয়া হয়েছে। বর্তমান ন্যাশনাল ব্যাকবোন নেটওয়ার্কের আওতায় ৫৮টি মন্ত্রণালয়, ২শ’ ২৭টি অধিদফতর/ দফতর ও সংস্থা এসেছে। বাড়তি ইনফ্রা নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। ওয়াইফাই জোন তো আগেই বসেছে। স্থাপিত হয়েছে ১ হাজার ২শ’ আইপি ফোন। সরকারী অফিসগুলোতে দ্রুত তথ্য বিনিময় এবং ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা দিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) ভবনে নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। উন্নত এত ব্যবস্থায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার যখন পরিকল্পনা করা হচ্ছে তখন এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ট্যাব ও ল্যাপটপে দিনের বেশিরভাগ সময় ফেসবুকে বসে কর্মঘণ্টার অপচয় করছেন। কয়েকটি দৃশ্যের উদাহারণ দিলেই তা আরও পরিস্কার হবে- জেলা প্রশাসন অফিসে সরকারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে কয়েক কর্মকর্তা সরকারী ট্যাব ব্যবহারে ফেসবুকে ছবি ও স্টেটাস দিয়ে খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। এখন কর্মকর্তাকে দেখা গেল পাশের নারী সহকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। দৃশ্য ২. সরকারী অফিসে বসে সরকারী ট্যাবে দীর্ঘক্ষণ ফেসবুকে চ্যাটিং করছেন। দৃশ্য ৩. ট্যাবে বসে কবিতা লিখছেন। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলে ফেসবুকে মনযোগী হয়ে সাফ জানালেন কবিতাগুলো আগে আপলোড করি। দৃশ্য ৪. একজন পুলিশ কর্মকর্তা দিনের প্রতিটি কাজ (সরকারী ও নিজস্ব) ট্যাবের ক্যামেরায় ধরে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি নানা ধরনের ছবি ফেসবুকে দিচ্ছেন। এমনকি কোথায় কবে বেড়াতে গেছেন তাও তুলে ধরছেন। দৃশ্য ৪. অনেক কর্মকর্তা অফিসে বসেই ফেসবুক শুরু করেন। কর্মঘণ্টা কতটা কমে গেল সেদিকে খেয়াল নেই। দেখা যায় ফেসবুকে যাদের আসক্তি পেয়েছে তারা প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২ ঘণ্টা অলস সময় নষ্ট করেন। এভাবে উন্নয়নের গতিধারা কতটা কমছে সেই হিসাব কেউ নিচ্ছে না। এই বিষয়ে একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বললেন, তিনিও বিষয়টি অনুভব করতে পেরেছেন। তবে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেই উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। তার কথা- যে প্রজন্মকে নিয়ে ফেসবুকের ভয় ছিল তা আর নেই। বর্তমানের শিক্ষার্থীরা খুব কম ফেসবুক ব্যবহার করে। নেটে বসে লিখাপড়ার জন্য। লেখাপড়াতেই মন দেয় বেশি। সাধারণত ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের ফেসবুকের আসক্তি বেশি। ব্যক্তিগত অধ্যায় থেকে মনের ভিতরের নানা অধ্যায়ে, প্রফেশনাল কলিগ থেকে সামষ্টিকভাবে নানাজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে তারা যোগাযোগের ওই মাধ্যমটির (ফেসবুক) অপব্যবহার করছে। ইদানিং সেলফি ব্যবহার করে ছবির অপব্যবহার শুরু হয়েছে। এতসব অপব্যবহার রোধে তার পরামর্শ সরকারী কর্মকর্তাদের অফিসে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অফিসের কাজ ছাড়া ট্যাব ও ল্যাপটপে সামাজিক যোগাযোগ সাইট বন্ধ রাখা। ওয়াইফাই জোনও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সরকারী কঠোর নির্দেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা। এর বাইরে আরও কি করা যায় তা উদ্ভাবন করা। তা না হলে দিনের পর দিন সরকারী কাজের অনেক কর্মঘণ্টা অপচয় হয়ে দ্রুত যাত্রার গতি রুদ্ধ হবে। অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এখনই। তা না হলে নিউরন এ্যাবিউজের এই নেশা কাটানো কঠিন হয়ে পড়বে। ইংরেজী প্রবাদের মতো ‘এ্যান আইডেল ব্রেন ইজ এ্যা ডেভিল ওয়ার্কশপ’ এ পরিণত হবে।
×