ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের সেরা অর্জন বাংলাদেশের ক্রিকেটের

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৬ জুন ২০১৫

ইতিহাসের সেরা অর্জন বাংলাদেশের ক্রিকেটের

মিথুন আশরাফ ॥ একদল ইতিহাসের সেরা অর্জন পেল। দলটির নাম- বাংলাদেশ। আরেকদল ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় দেখল। দলটির নাম- ভারত। অথচ কী আশ্চর্য্য, দুই দলই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শেষে খুশি! ভারত দলের ক্রিকেটাররা তো রীতিমত তৃতীয় ওয়ানডে জিতে কেক কেটে উৎসব করেছেন! বাংলাদেশের খুশি হওয়ার, আনন্দ করার, উৎসবে মাতার উপলক্ষের শেষ নেই। প্রথমবারের মতো ভারতকে সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ। র‌্যাঙ্কিংয়ের ২ নম্বরে থাকা একটি দলকে প্রথমবারের মতো সিরিজে হারিয়েছে। দুর্বল দলের বিপক্ষেই বাংলাদেশ সিরিজ জিতে নেয়, সেই অপবাদও এবার শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে দূর হয়েছে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হারের প্রতিশোধও নেয়া গেছে। ২০০৬ সালের পর আবার আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করে নিয়েছে। একসঙ্গে অনেক প্রাপ্তি মিলেছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাই যেমন বলেছেন, ‘সেরা অর্জনই এটা।’ তাই উল্লাসে ফেটে পড়তেও পারেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে পুরো জাতি। তাই বলে ভারতের ক্রিকেটাররাও আনন্দে মাতবেন! তা কী করে হয়! কী আশ্চর্য্য, বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হেরেও ভারতের ক্রিকেটারদের ভেতরে নেই কোন দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি, আফসোস! তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের এক ওয়ানডেতে জিতলেন ধোনি, কোহলিরা। তাতেও কী খুশি! বুধবার তৃতীয় ওয়ানডেতে জিতে রাতেই ড্রেসিংরুমে কেক কেটে উৎসবও করলেন ধোনিরা। কোন দল সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরে এতটা আনন্দ করতে পারে। তাও আবার নিজেদের ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়টি শেষ করে! যা আগে কোনদিন হয়নি, তা এবার হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় ৩ ম্যাচ বা তারচেয়ে বেশি ম্যাচের সিরিজে এর আগে কখনই টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কিংবা জিম্বাবুইয়ের কাছে হারেনি ভারত। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে এখনও তা অব্যাহত থাকলেও, এবার বাংলাদেশের কাছে ভারতের সেই অহংবোধ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। কলঙ্ক হয়ে গেল এ অধ্যায়। এমন সময় যেখানে ক্রিকেটারদের হতাশ থাকার কথা, তা না হয়ে উল্টো উৎসব হয়েছে। কেন? জানা গেল, আসলে সিরিজে একটি ম্যাচে জয়ের জন্য নয়, একটি ক্রিকেট মৌসুম সফলভাবে শেষ করায় এ আনন্দ উদযাপন করা হয়েছে। সেখানে শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়, পুরো মৌসুমে যে ভারত ৭৫ শতাংশ জয় পেয়েছে, সেটিকেই আমলে নেয়া হয়েছে। তাই বলে বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারের পর এমন আনন্দ মানায়? সেই প্রশ্নও উঠে গেল। তাতে ভারত ক্রিকেট দলের কী আসে যায়। দলের ক্রিকেটাররা মিডিয়াকে পাত্তাই দেন না। তাই তো হার নিয়ে না ভেবে উৎসব করতে পারেন। শেষ ম্যাচে সান্ত¡নার জয় নিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকাও ছেড়েছেন ভারতের ক্রিকেটাররা। সকাল ১০টা থেকে একেকজন একেক ফ্লাইটে করে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সকাল ১০টায় দিল্লীর উদ্দেশে ছাড়া প্রথম ফ্লাইটে চলে যান অধিনায়ক ধোনি, সহ অধিনায়ক বিরাট কোহলি, ওপেনার শিখর ধাওয়ান, পেসার মোহিত শর্মাসহ ৫ ক্রিকেটার। ১১টার মুম্বাইয়ে উদ্দেশে ছাড়া অন্য একটি ফ্লাইটে করে ধাওয়াল কুলকার্নি, উমেশ যাদব, আম্বাতি রায়ুডু এবং আজিঙ্কা রাহানেসহ চলে যান ৭ ক্রিকেটার। এছাড়া অন্য একটি ফ্লাটে গেলেন এক কোচিং স্টাফসহ আরও তিনজন। শুধু ফ্লাইট না পাওয়ায় ঢাকায় থেকে যান রবিচন্দ্রন অশ্বিন। রবিশাস্ত্রীসহ কোচিং স্টাফ এবং টিম ম্যানেজমেন্টের বাকিদের সঙ্গে আজ অশ্বিনও যাবেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররাও যে যার যার বাড়িতে পৌঁছে গেছেন। এ মাসের ৮ তারিখে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে বাংলাদেশে আসে ভারতের টেস্ট দল। ১০ জুন থেকে ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলি স্টেডিয়ামে শুরু হয় সিরিজের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির কারণে এই ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত সমাপ্তির মুখ দেখতে পারেনি। ড্র হয়। ১৮ জুন থেকে মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুরু হয় তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। তার দু’দিন আগেই অবশ্য মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ওয়ানডে দলে থাকা ৮ ক্রিকেটার ঢাকায় এসে পৌঁছায়। মেলবোর্নে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের সঙ্গে ন্যাক্কারজনক সেই ঘটনার পর ভারতের বিপক্ষে এই ওয়ানডে ম্যাচ নিয়ে ছিল তুমুল উত্তেজনা। সেই উত্তেজনার মধ্যেই মাঠে গড়ায় প্রথম ম্যাচ এবং ধোনিদের দর্পচূর্ণ করে দিয়ে বাংলাদেশ জয় তুলে নেয় ৭৯ রানের বিশাল ব্যবধানে। বাংলাদেশের জয়ের নায়ক তরুণ পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আরও প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে ভারত। কিন্তু মুস্তাফিজের বলে বিভ্রান্ত হয়ে ২০০ রানেই অলআউট হয় ভারত। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যায় বৃষ্টি আইনে ৬ উইকেটের ব্যবধানে। শেষ ওয়ানডেতে এসে টস জিতেও বাংলাদেশ ফিল্ডিং নেয়। ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের সামনে ৩১৮ রানের বিশাল লক্ষ্য বেঁধে দেয় ভারত। বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায় ২৪০ রানে। ভারত জয় পায় ৭৭ রানের ব্যবধানে। ভারতকে ‘বাংলাওয়াশ’ করার স্বপ্ন হাতছানিই দিচ্ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। শেষ ম্যাচ হেরে গেলেও বাংলাদেশ সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জিতে নিল। ৫৯তম ওয়ানডে সিরিজ খেলে ১৮তম সিরিজ জয় করল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সাল থেকে ওয়ানডে সিরিজ খেলা শুরু করে ২০০৫ সালে এসে প্রথমবার সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়েকে ৩-২ ব্যবধানে হারাল। সে কী আনন্দ! এরপর শুরু হলো সিরিজে জেতা। এরপর কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডকেও সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়েকেও হোয়াইটওয়াশ করার মতো আনন্দ মিলেছে। ২০০৯ সালে এসে বিদেশের মাটিতে টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। যদিও দলটি দুর্বল ছিল। তবুও সিরিজে হারানো গেছে তো। ক্রিকেটপ্রেমীরা আনন্দে উন্মাতাল হয়ে যান। ২০১০ সালে যখন নিউজিল্যান্ডকে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ, আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। ২০১৩ সালেও এ দলটিকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে যেন বাংলাদেশকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধুই হার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পর ২০১৩ সালের নবেম্বর থেকে ২০১৪ সালের নবেম্বর পর্যন্ত, এই এক বছরে শুধু হেরেছে বাংলাদেশ। টানা ১২ ওয়ানডেতে হার হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানের মতো দলের বিপক্ষেও হার সহ্য করে নিতে হয়েছে। পরিবর্তন করা হলো নেতৃত্বেও। মাশরাফি বিন মর্তুজার হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হলো। তাতেই সব পাল্টে গেল। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের শুরুও যেন সেখানেই হলো। যেই গত বছর নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ে খেলতে আসল বাংলাদেশে, ঘুরে দাঁড়াল মাশরাফিরা। সেই যে সাফল্য শুরু হলো, তা চলছেই। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে টানা ৫ ওয়ানডে জয় হলো। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা ৩ ওয়ানডে জিতল। ভারতকেও টানা ২ ওয়ানডেতে হারিয়ে সিরিজ জেতার সাফল্য কুড়িয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় ওয়ানডেতে হারলেও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জিতেই যে সিরিজ জয় নিশ্চিত হয়ে গেছে, তাতেই বাংলাদেশ ইতিহাসের সেরা অর্জন কুড়িয়ে নিয়েছে। এত শক্তিশালী, বড় মাপের ও র‌্যাঙ্কিংয়ের দ্বিতীয় স্থানে থাকা দলকে যে কখনই হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে এ সিরিজ জয়ে যে ২০০৬ সালের পর আবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তাই তো মাশরাফি বলতে পেরেছেন, ‘কেউ হয় তো চিন্তা করেনি যে, আমরা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতব।‘ অনেকেই ভেবেছে, আমরা একটা ম্যাচও জিততে পারি কি না। প্রথম দুটি ম্যাচে আমারা প্রাপ্য জয় পেয়েছি। আশা করি, ভবিষ্যতে এভাবে খেলতে পারব। সেরা অর্জনই পেয়েছি আমরা।’
×