ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আট দিন পর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান;###;ফিরতে পেরে আনন্দিত ॥ রাজ্জাক

মংডুতে পতাকা বৈঠকে সিদ্ধান্ত ॥ ফিরলেন রাজ্জাক

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৬ জুন ২০১৫

মংডুতে পতাকা বৈঠকে সিদ্ধান্ত ॥ ফিরলেন রাজ্জাক

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার সীমান্তে বিজিপির হাতে অপহৃত বিজিবি নায়েক রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মংডুতে পতাকা বৈঠকের মধ্য দিয়ে রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনা হয়। টেকনাফের মাটিতে পা রেখে আপ্লুত রাজ্জাক বললেন, আমি সুস্থ আছি। এ সময় সতীর্থ ছিলেন দারুণ উৎফুল্ল। উৎসুক জনতার মাঝে ছিল বিজয়ের হাসি। রাজ্জাকের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে বিজিবি-বিজিপির আট দিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটল। মংডুতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পতাকা বৈঠকে রাজ্জাককে বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে বিজিপি। এরপর বিকেলে পিলখানায় সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি প্রধান আজিজ আহমেদ জানান, কোন শর্ত ছাড়াই রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এ খবরে নাটোরে রাজ্জাকের গ্রামের বাড়িতে স্বস্তি ফিরে আসে। পরিবার এজন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে। দিনভর ছিল ভারি বৃষ্টি। উত্তাল সাগরসংলগ্ন নাফ নদীর মোহনায় ছিল বর্ষণসিক্ত বৈরী পরিবেশ। এর মধ্যেই সন্ধ্যায় রাজ্জাককে টেকনাফে ফিরিয়ে আনা হয়। ঘনঘোর রাজ্জাককে ফেরত আনার বিষয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার পিলখানায় বিজিবির সদর দফতরে বিজিবি প্রধান সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছেন। পাশাপাশি টেকনাফে বক্তব্য দেন বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ আবু জার আল জাহিদ। তাঁর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সকালে মংডুতে গিয়ে টানা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বৈঠকে দু’দেশের বর্ডার ম্যানেজমেন্টসংক্রান্ত নানা আলোচনা শেষে সন্ধ্যার মধ্যে অপহৃত রাজ্জাককে সঙ্গে নিয়ে টেকনাফে ফিরে আসে। উল্লেখ্য, গত ১৭ জুন ভোরে টেকনাফের নাফ নদীতে নিয়মিত টহলদানকালে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা নাফ নদীর সীমানা অতিক্রম করে একটি ইঞ্জিন বোটসহ নায়েক রাজ্জাক ও বোটচালক লাল মোহন দাস এবং তার ভাগ্নেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে বোটচালক লাল মোহন দাস ও তার ভাগ্নের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে বিজিপি ঐ দিনই তাদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু আটকে রাখে নায়েক রাজ্জাককে। শুধু তাই নয়, আটক করার পর তার ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালায়। আবার নির্যাতনের এ চিত্র সে দেশের পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমেও প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় বিজিবি কর্তৃপক্ষ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শুরু হয় ব্যাপক তৎপরতা। এর আগে অপহরণের পর পরই বিজিবি ৪২ ব্যাটালিয়ন থেকে রাজ্জাককে ছেড়ে দেয়ার জন্য বার বার তাগাদা দেয়া হয়। কিন্তু বিজিপি কর্তৃপক্ষ নানা টালবাহানা শুরু করে। একপর্যায়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ এবং রাজ্জাককে নিঃশর্তে মুক্তিদানের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা রাজ্জাককে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের একঘণ্টা সময় পর অর্থাৎ সকাল সোয়া এগারোটার দিকে মংডুতে বিজিপি-বিজিবির মধ্যে পতাকা বৈঠক শুরু হয়। মিয়ানমার অভ্যন্তরে এন্টি-এক্সিট পয়েন্ট-১ এর ‘দেওয়ান নান্দি হলে’ বৈঠক চলাকালে দুপুর দেড়টার দিকে অপহৃত নায়েক রাজ্জাককে হাজির করা হয়। ২টা ১০ মিনিটে বৈঠক স্থলে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্জাককে হস্তান্তর করে বিজিপি। দু’দেশের পতাকা বৈঠক দুপুরে বিরতির পর বিকেল প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত চলে। এর আগে সকাল পৌনে দশটার দিকে টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে ৪২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের বিজিবি প্রতিনিধি দল দুটি স্পিডবোটযোগে মংডুর উদ্দেশে রওনা হয়। মংডুতে পতাকা বৈঠকে বিজিপির পক্ষে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্রাঞ্চের অধিনায়ক লে. কর্নেল থিন হান। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল মোঃ আবু জার আল জাহিদ। বৈঠকে রাজ্জাককে হস্তান্তর করার আগে মিয়ানমারের বিজিপির পক্ষে একাধিক বিষয় তুলে ধরা হয়। যা ছিল বর্ডার ম্যানেজমেন্টসংক্রান্ত। এর মধ্যে ছিল নাফ নদীতে মাছ ধরা নিয়ে প্রায়শ সীমানা অতিক্রমের ঘটনা। এছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমারের এক মহিলা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসে গ্রেফতার হওয়ার একটি ঘটনা। এছাড়া ১৭ জুনের ঘটনায় দু’পক্ষের গোলাগুলিতে বিজিপির এক রাইফেলম্যান গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অনুরোধ করা হলে বিজিবির অধিনায়ক তাঁকে দেখতে যান। এছাড়া বৈঠকে নাফ নদীর জিরো লাইন অতিক্রমের ঘটনাসহ সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের দায়িত্বের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৮০ সালের দু’দেশের ল্যান্ড বাউন্ডারির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। বৈঠকে বিজিপির পক্ষ থেকে বলা হয় নায়েক রাজ্জাক পোশাকবিহীন ছিল। কিন্তু বিজিবির পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে তিনি পূর্ণাঙ্গ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় অস্ত্র ও টর্চ হাতে টহলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ নেই। বৈঠকে তিনটি পয়েন্টে জয়েন্ট ডিক্লারেশন স্বাক্ষর করে উভয়পক্ষ। বৈঠক শেষে বিজিপির পক্ষ থেকে নায়েক রাজ্জাককে তাঁর অস্ত্র, ম্যাগজিন ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ হস্তান্তর করার পর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা একজন ডাক্তার তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এরপর তাঁকে গ্রহণ করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মংডু থেকে টেকনাফে ফিরে এসে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী বিজিবি অধিনায়ক জানান, রাজ্জাকের আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তাঁর শরীরে কোন রকমের সমস্যা থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হলেই তিনি কাজে যোগ দেবেন। গত ১৭ জুন বুধবার ভোরে টেকনাফের নাফ নদীর জাদিমুরা সীমান্ত পয়েন্ট নাফ নদীর লাল দিয়ারচর এলাকায় দু’পক্ষের গোলাগুলির সময় নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। ওই সময় বিজিবি সিপাহি বিপ্লব গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে তাঁকে চট্টগ্রামে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত। ঘটনার পর রাজ্জাককে ফিরিয়ে দিতে বিজিবির পক্ষ থেকে কয়েক দফা পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হলেও সাড়া দেয়নি বিজিপি। পরে বাংলাদেশের অব্যাহত চাপের মুখে টানা আট দিন পর বৃহস্পতিবার পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে রাজ্জাককে ফেরত দিতে বাধ্য হয় বিজিপি। রাজ্জাককে ফেরতদানসংক্রান্ত পতাকা বৈঠকে বিজিপি সীমান্তসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরলেও অধিকাংশ বিষয় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এদিকে, মংডু থেকে নায়েক রাজ্জাককে নিয়ে আসার খবরে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে টেকনাফ স্থলবন্দর এলাকায়। দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা এ সৈনিককে এক নজর দেখতে এবং মিয়ানমারের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানাতে প্রতিবাদী যুবকদের অনেকে সকাল থেকে স্থলবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন। মংডু থেকে বিজিবি প্রতিনিধিদল টেকনাফের স্থলবন্দরে সন্ধ্যা ছয়টা ২৫ মিনিটে। ওই সময় সাংবাদিকদের ব্রিফিং দেন বিজিবি প্রতিনিধিদলের নেতা লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ। তিনি বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এ ঘটনা ঘটেছিল বলে বৈঠকে আলোচনা হয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলেও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ২০১৪ সালের ২৮ মে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিপি ৫২নং সীমান্ত পিলারের পাশে টহলদলের ওপর বিনা উস্কানিতে গুলি করেছিল। এতে নাইক্ষ্যংছড়ির পাইনছড়ি বিওপির নায়েক মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে মারা যান। পরে ওই বিজিবি সদস্যের লাশ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা সেদেশে নিয়ে যায়। বিজিবি কর্তৃপক্ষের কড়া প্রতিবাদের মুখে ৩ দিন পর ৩১ মে নিহত নায়েক মিজানের লাশ ফেরত দিতে বাধ্য হয় মিয়ানমারের বিজিপি কর্তৃপক্ষ। বার বার সীমান্তে এভাবে বিনা উস্কানিতে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যদের গুলিবর্ষণ ঘটনায় ভাবিয়ে তুলেছে অভিজ্ঞমহলকে। এ ঘটনার পর সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা না থাকলেও স্থানীয় জেলেরা নাফ নদীতে মাছ শিকারে যেতে ভয় পাচ্ছে। তবে বুধবার সকাল থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় শৃঙ্খলা স্থিতিশীল রাখতে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। এসব ঘটনা ছাড়াও নাফ নদীতে বিজিবি ও জেলেদের ওপর গুলি করে আহত এবং জেলেদের অপহরণ করে সেদেশে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বিজিপির বিরুদ্ধে। চলতি বছরের এপ্রিলে নাফ নদী থেকে ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দিয়েছে টেকনাফের হোয়াইক্যং, উখিয়ার পালংখালী ও রহমতেরবিল এলাকার বহু জেলেকে। মুক্তিপণের টাকার জন্য মাছ শিকাররত জেলেদের অহেতুক ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে গুমধুমের বাসিন্দা পুতিক্যা নৌকাসহ পালানোর চেষ্টা করলে বিজিপি সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। মার্চ মাসেও লালদিয়া নামক স্থানে বিজিবি সদস্যরা একটি নৌকা তল্লাশির সময় বিজিবি টহলদলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল বিজিপি। প্রায় সময়ই বাইশারি ও তুমব্রু এলাকার বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশ জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে কাঠুরিয়া ও ক্ষেত-খামারিদের ধরে নিয়ে যায়। পরে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয় অথচ আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনানুসারে বিজিপিকে বাংলাদেশ জলসীমায় আসতে হলে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ জলসীমায় আসার পূর্বে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তৎকালীন নাসাকা (বর্তমানে বিজিপি) সদস্যরাও পূর্ব অনুমতি না নিয়ে বা তৎকালীন বিডিআরকে (বর্তমানে বিজিবি) অবহিত না করে যখন-তখন বাংলাদেশ জলসীমায় ঢুকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ধরে নিয়ে যেত কাঠুরিয়াদের। এছাড়া বিজিপির সদস্যদের বড় একটি অংশ সীমান্তে চোরাচালান কাজে সম্পৃক্ত। এদের সহযোগিতায় এদেশে মাদক ইয়াবাসহ মানব পাচারের বহু ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার আমলে নাইক্ষ্যংছড়ি রেজু আমতলী বিডিআর ক্যাম্পে তৎকালীন নাসাকা সদস্যরা হামলা চালিয়ে ওয়্যারলেস টাওয়ার ও সীমান্ত ফাঁড়ি ভাংচুর করেছিল। অতর্কিত গুলি করে রেজু ক্যাম্প দখলে নিয়ে জিম্মি করে রেখেছিল বিডিআর জওয়ানদের। ওই সময় নাসাকা বাহিনীর গুলিতে বিডিআর সৈনিক ল্যান্স নায়েক মোশারফ হোসেন ও আবু তাহের নামে এক গ্রামবাসী নিহত হয়। পরে নাসাকারা ফিরে যাওয়ার সময় বিডিআর ক্যাম্প থেকে ২৩টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় মিয়ানমারে। পরে অবশ্য কূটনৈতিক চাপের মুখে অস্ত্রগুলো ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল নাসাকরা। সেই নাসাকা পরিবর্তন করে বর্তমানে দেশটির সীমান্ত পাহারায় দেয়া হয়েছে বিজিপিকে। সীমান্তরক্ষীদের নাম বিজিপি করা হলেও বিজিপি সদস্যরা নাসাকার নীতি পরিবর্তন করেনি।
×