ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী খাতের ঋণ বনাম জিডিপি প্রবৃদ্ধি

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৬ জুন ২০১৫

বেসরকারী খাতের ঋণ বনাম জিডিপি প্রবৃদ্ধি

২০১৫-১৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মধ্যে একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, তারা পর্যাপ্ত ঋণ ব্যাংক থেকে পাবেন না। এর কারণ? কারণ সরকার আগামী বছর ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় একটু বেশি ঋণ ব্যাংকিং খাত থেকে নেবে। কত বেশি? মাত্র ৬ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে সংশোধিত বাজেট মোতাবেক ঋণ নেবে ৩১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। সেই স্থলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়লেও সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমবে। তাও কমবে ৬ হাজার কোটি টাকা। অতএব অভ্যন্তরীণ উৎসে সরকারের ঋণ সেভাবে বাড়ছে না। একটায় বাড়ছে, অন্যটায় কমছে। যেটায় বাড়ছে সেখানেই দেখা যাচ্ছে আপত্তি। চলতি বছরে ব্যবসায়ীদের আপত্তি ছিল সঞ্চয়পত্রের মারফত সরকারী ঋণ। এবার তাদের আপত্তি সরকারের ব্যাংকঋণ নিয়ে। এখানে তাদের আপত্তি দুই রকমের। প্রথমত এতে সুদের হার বেশি। অতএব সুদের হার এক অঙ্কে নামাতে হবে। এর জন্য এফবিসিসিআইয়ের নব্য সভাপতি একটি কমিটি করেছেন যার সভাপতি তিনি নিজেই। মজার ঘটনা, ‘সুদহ্রাস কমিটি’র সভাপতি হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল নজরুল ইসলাম খান সাহেবকে, যিনি তা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, তিনি ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতা এবং একটি ব্যাংকের মালিক। অনুমান করা যায় তার দুই ভূমিকা! ‘এফবিসিসিআই’র সদস্য হিসেবে ব্যাংকের সুদ হ্রাস করা এবং ব্যাংক মালিকদের নেতা হিসেবে সুদের হার উঁচু রাখা। তা না হলে তিনি সুদহ্রাস কমিটির সভাপতি হতে চাইলেন না কেন, এটা আমি বুঝতে অক্ষম। সে যাই হোক, সুদ হ্রাস করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি। আরেক দাবি হচ্ছে সরকারের ঋণ নিয়ে। দাবি বলা ঠিক হলো না রোধ হয়। তারা আশঙ্কা করছেন সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তাদের ঋণে টান পড়বে। তাদের ঋণে টান পড়লে কী হবে? তারা এখন হরহামেশাই বলছেন দেশের ‘উন্নতি’ তারা করছেন। তারা ব্যাংকঋণ না পেলে দেশের ‘উন্নয়ন’ হবে না। যত বেশি ব্যাংকঋণ তাদের দেয়া হবে দেশের উন্নতি তত বেশি হবে। দৃশ্যতই তারা কৃষকের অবদান, ওয়েজআর্নারদের অবদানের কথা বিস্মৃত হচ্ছেন। এটা তাদের করা উচিত কিনা- এই প্রশ্নে আজ আমি পাব না। আমি দেখাতে চাই বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি মানেই ‘উন্নতি’ নয়। উন্নতি বলতে আমরা সাধারণভাবে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হারকে ধরি। ‘জিপিডি’ প্রবৃদ্ধির হার যত বেশি হবে তত বেশি উন্নতি হচ্ছে হলে ধরা হবে। ‘জীবনধারণের গুণগতমান বৃদ্ধি’ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ মানুষের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে কি-না, পানীয় জলের ব্যবস্থা হচ্ছে কি-না, সর্বনিম্ন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কি-না, মানুষের সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মিটছে কি-না এসবের ভিত্তিতে যে ‘হিউম্যান ডেভেলপেমন্ট ইনডেক্স’ (এইচডিআই) তৈরি হয় তাও আজকাল কিন্তু উন্নয়নের হিসাবের ভিত্তি। আমি ঐ ভিত্তিতে যাব না। সেটা ভিন্ন আলোচনা। আজকের আলোচনায় আমি বেসরকারী খাতের ঋণের সঙ্গে ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি’র হারের কতটুকু সম্পর্ক আছে সেই কথা বলার চেষ্টা করব। মুখে মুখে আমরা যাই বলি না কেন, প্রচলিত বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তথ্যে দেখা যাচ্ছে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পেলেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সরাসরি বৃদ্ধি পায় না। উদাহরণ দিই। বিগত দশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০০৬-০৭ অর্থবছরে। সে বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। ঐ বছরে বেসরকারী খাতে ঋণ বেড়েছে কত শতাংশ? মাত্র ১৫ দশমিক ০১ শতাংশ। আসা যাক, ২০১০-১১ অর্থবছরে। সেই বছর বিগত ১৪ বছরের মধ্যে বেসরকারী খাতে ঋণ বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। ঐ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত ছিল? মাত্র ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ১৫ দশমিক ১ শতাংশ ঋণ বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ ঋণ বাড়িয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব ২০১৪-১৫ অর্থবছরের। সরকারের হিসাবে জিডিপি বাড়বে সাড়ে ছয় শতাংশ হারে। বেসরকারী খাতে ঋণ বাড়বে কত পরিমাণে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের আগ পর্যন্ত হিসাবে বেসরকারী খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তিন মাসে ধরে নিলাম তা হবে মোটামুটি ১৫-১৬ শতাংশ। এই হিসাবের সঙ্গে অন্যান্য বছরের হিসাবের তুলনা করলেও বোঝা যাবে বেসরকারী খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। সাদা চোখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। অন্যান্য বছরের তথ্য দিয়ে পাঠকদের আমি ভারাক্রান্ত করতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে চাই, ব্যবসায়ীদের দুটো দাবিই অতি সরলীকৃত। ঋণের সুদের হারই শিল্পায়নের একমাত্র বা বড় বাধা তা সর্বাংশে সত্য নয়। দ্বিতীয়ত সরকার ঋণ নিলেই তারা ঋণ পাবেন না এ কথা তত্ত্বভিত্তিক যেমন নয়, তেমনি তারা ঋণ নিলেই জিডিপি আপনাআপনি বাড়বে এ কথাও ঠিক নয়। বস্তুতপক্ষে বেসরকারী খাতে ঋণ বৃদ্ধির যেমন প্রয়োজন আছে, তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন ঋণের সদ্ব্যবহার। একটা উদাহরণ দিই, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে বিগত ১৪-১৫ বছরের মধ্যে বেসরকারী খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। বেড়েছে যথাক্রমে ২৪ দশমিক ২৪ এবং ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ভাবা যায়? এবার এর সঙ্গে সংযুক্ত করুন শেয়ারবাজারের উল্লম্ফন। ঐ সময়টাতেই জমির দামও বাড়ে, শেয়ারের দামও মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ে এবং পরে ধস নামে। বলা বাহুল্য, এখানে বেসরকারী খাতের ঋণের একটা বড় ভূমিকা আছে। এ কথা আজ জলের মতো পরিষ্কার যে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঐ টাকার একটা বড় অংশ শেয়ারবাজারে খাটান। এর ফল কী হয়েছে তার কথা না বলাই ভাল। মূল্যস্ফীতি কী পর্যায়ে উঠেছিল তার কথাও আমাদের মনে আছে। পরবর্তী বছরগুলোতে ঐ ভুল শোধরানো হয়েছে। এর ফলও আমরা পাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি বেশকিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যহ্রাসের ঘটনাও এই ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। কিন্তু ঋণ সঙ্কোচনের নীতিও কাজে লেগেছে। দেখা যাচ্ছে বিগত তিন বছর যাবত বেসরকারী খাতের ঋণ বেশ নিয়ন্ত্রিত। এতে কি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে ব্যাঘাত ঘটছে? না, আমি তা মনে করি না। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির বাধা অন্যত্র এবং এসবের কথা আমরা জানি। আমি যে কথাটি বোঝাতে চাইছি তা হলো বেসরকারী খাতে ঋণ যেতে হবে, ঋণের প্রবাহও ঠিক রাখতে হবে। তবে তা হতে হবে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ ঋণের টাকা নিয়ে যাতে জমি কেনা না হয় তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঋণের টাকা নিয়ে যাতে শেয়ার ব্যবসা না হয় তার দিকে নজর দিতে হবে। এসব গুরুত্বপূর্ণ দিকের সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আমরা আজকাল সব সময়ই পুঁজি পাচারের কথা বলছি। বিদেশী ব্যাংকে বাংলাদেশীরা টাকা রাখছে। টাক পাচার হচ্ছে, ভাল টাকা কালো টাকা সবই পাচার হচ্ছে। এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন আলোচনা হচ্ছে। কত বিচিত্র আলোচনা। প-িতদের মতামতের কোন অভাব নেই। তবে দৃশ্যত উদ্বেগ আমাদের কম। কিন্তু উদ্বেগ থাকা দরকার। কালো টাকা না ভাল টাকা পাচার হচ্ছে- এই প্রশ্ন আলাদা প্রশ্ন। এখন এই আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি শুধু একটা কথা এখানে বলতে চাই, টাকা পাচারের প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে ‘ওভার ইনভেয়েসিং’। আবার এই ‘ওভার ইনভয়েসিং’ হচ্ছে পুরাতন ও নতুন ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক মূলধন গঠনের (প্রাইমারী এক্সমেলেশন অব ক্যাপিটাল) একটা বড় মাধ্যম। ‘আমদানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো’র মধ্যে ব্যবসায়ীরা ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর সুযোগ গ্রহণ করে। আমাদের দেশের লোকদের ক্যাপিটাল নেই। তারা ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে ‘ক্যাপিটাল’ করে নেয়। এটা ‘ওপেন সিক্রেট’। এখন প্রশ্ন- এই ধরনের মূলধন গঠন করতে আমরা দেব কি-না? যদি না দেই তাহলে এক রকমের আলোচনা হবে। আর যদি দেই তাহলে আরেক রকমের আলোচনা হবে। তবে এ কথা ঠিক, ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমেই টাকা পাচার হয়। উল্টো ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ করে টাকা দেশে আবার আসেও। ব্যবসায়ী/হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ওভার ইনভয়েসিং সূত্র থেকেই বাইরে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ব্যাংকাররা সাক্ষী। তাদের নলেজের বাইরে এসব ঘটে না। ব্যবসায়ীরা হয়ত ২০ কোটি টাকা ওভার ইনভয়েসিং করে চীনে নিল। তার পুরোটাই লাভ, ব্যাংকের টাকা সে তার পুঁজি হিসেবে রেখে দিল। ব্যাংকারের লাভ? লাভ আছে। অনেক ব্যাংকার হয়ত একটা-দুইটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেল। ব্যবসায়ীর তুলনায় ব্যাংকারের লাভ কিন্তু সামান্যই। কিন্তু বদনাম শতভাগ তারই। ব্যবসায়ীদের কথা কেউ বলে না। কারণ তারাই দেশের মালিক। টাকা পাচর বন্ধ করতে হলে, ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটা যৌথভাবে করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং সরকারী এজেন্সিগুলোকে। এই যৌথ কাজটি বড়ই কঠিন। যৌথ কাজ যৌথভাবে হয় না। এখানেই গিট্টু। এই ‘গিট্টু’ না ভাঙলে টাকার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। করা যায় না বলেই ঋণের প্রবাহ অতিরিক্ত বেড়ে যায়। দশ টাকার যন্ত্রপাতি ২০ টাকা দিয়ে আমদানি হলে ঋণের টাকাও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। লেখক : ম্যাজেমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি।
×