ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এম মোস্তাফিজুর রহমান

সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২৬ জুন ২০১৫

সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে করণীয়

মানবপাচার হচ্ছে এমন এক প্রতারণামূলক কর্মকা-, যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে কাজ বা চাকরির উদ্দেশ্যে বিদেশে গমন, অভিবাসন বা বহির্গমনে প্রলুব্ধ করা হয়। এছাড়া কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করে বা প্রতারণা করে ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে বা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দেশের বাইরে বিক্রি করাকেও মানবপাচার বোঝায়। এটি মূলত মানবসভ্যতার প্রতি উপহাস, বর্বর যুগের প্রতিচ্ছবিকেই ইঙ্গিত করে। ১৮৬৫ সালে তদানীন্তন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের শাসনামলে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দাস প্রথা আজও বিলুপ্ত হয়নি। ইতিহাসের ক্রমধারায় একবিংশ শতাব্দীর এই যুগেও সেই ধারাবাহিকতা এখনও পরিলক্ষিত হয়। এক সময়ে নতুন আবিষ্কারের নেশায় ইউরোপের অভিযাত্রীরা ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি জমাতেন। কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা এভাবেই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ইউরোপীয়রা তখন সমুদ্র পাড়ি দিত মূলত নতুন উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্যে। আজকের যুগে আমাদের হতদরিদ্ররা একই পথে ছুটছে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষকালেও পৃথিবীতে আজও এ অবস্থা বিরাজমান। আফ্রিকানরা সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাচ্ছে, কিউবানরা আমেরিকা আর বাংলাদেশীরা জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে। এই অবৈধ পন্থায় বিদেশ গমনের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অভিবাসন একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের বৈদেশিক আয়ের বড় একটি অংশ আসে অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। বাংলাদেশও তেমনই একটি দেশ। প্রতি বছর এ দেশ থেকে কয়েক লাখ লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে জীবিকার তাগিদে। তবে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে নয়, আকাশপথে। সম্প্রতি জীবিকার খোঁজে সাগর পাড়ি দেয়ার পুরনো সেই কৌশলটি প্রয়োগ হচ্ছে। পাসপোর্ট ও ভিসাবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ ট্রলারযোগে গাদাগাদি করে মানুষ পাড়ি দিচ্ছে সমুদ্র। সোনালি স্বপ্নের মোহে আচ্ছন্ন যাত্রীদের একটাই আশাÑ ট্রলারে উঠতে পারলেই পৌঁছে যেতে পারবে স্বপ্নের ভূমিতে। কিন্তু পথে পথে রয়ে যায় বিভিন্ন দেশের সীমান্তরক্ষীদের কড়া নজরদারি, ধরা পড়লে জেল কিংবা মৃত্যু অবধারিত। সেইসঙ্গে রয়েছে ট্রলারে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও নানা শঙ্কার দোলাচল। এত কিছুর পর মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পরও তাদের জন্য অপেক্ষা করে ভয়াবহ সব বিপত্তি। কখনওবা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কারাগারের দুঃসহ যাতনা কিংবা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে থাকা। অনেক সময় বিক্রি হয়ে পণ্যে পরিণত হয় তারা। বিনিময় হতে থাকে এক হাত থেকে অন্য হাতে। বেছে নিতে হয় পুরনো ধারার আধুনিক দাসের জীবন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় সমুদ্রপথে মানবপাচারের বিষয়টি বারবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। একটুখানি ভাল জীবনের আশায় মানুষ না বুঝেই এই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। এভাবে সহজ-সরল সাধারণ মানুষকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে জিম্মি করছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সমুদ্রপথে জীবনকে হাতের তালুর ওপর রেখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াচ্ছে হাজার হাজার ভাগ্যান্বেষী মানুষ। শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে তারা মায়ানমার, থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূল হয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করে মালয়েশিয়ায়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এসব দেশের প্রভাবশালী আদমপাচার চক্র। উন্নত জীবনযাপনের আশায় দালালদের প্রলোভনে পা দিয়ে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত সাগরপথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। পাশাপাশি অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে গত কয়েক বছরে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক বিপুলসংখ্যক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই বিপদসঙ্কুল এ যাত্রা রোধ করা যাচ্ছে না। সমুদ্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞতা এর একটি অন্যতম কারণ। যাই হোক, সভ্যসমাজে এই অসহায় মানুষগুলোকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে বিবেকবান সবাইকে জেগে উঠতে হবে। এজন্য দরকার সবার সমন্বিত প্রয়াস। সাম্প্রতিককালে মানবপাচারকারীদের দৌরাত্ম্যের ব্যাপকতা বেড়েছে। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি আফ্রিকান অভিবাসীদের বহনকারী একটি নৌকা ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে কমপক্ষে ৪০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়। এ অভিবাসীরা ইতালির উদ্দেশে লিবিয়া থেকে একটি নৌকায় রওনা দিয়েছিল বলে উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা জানিয়েছেন। এ সময় আবহাওয়া ভাল থাকায় ভূ-মধ্যসাগরে মানুষ পাচারের হিড়িক পড়ে। ভূ-মধ্যসাগরের ওপারেই ইতালি। তাই সাব সাহারীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অভিবাসনের চেষ্টা চালিয়ে থাকে। সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে স্বাভাবিকভাবে প্রথমে সমুদ্রে পাচারকারীদের প্রতিহত করার বিষয়টি সবার মাথায় চলে আসে। তবে এটি আসলে প্রতিরোধ করতে হলে এর উৎপত্তিস্থল থেকেই বিনষ্ট করা দরকার। এজন্য সারাদেশে দালালদের মাধ্যমে সংগ্রহ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে উপকূলের বিভিন্ন গুপ্তাশ্রয়ে তাদের একত্রে জড়ো করার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সময় পাচার চক্রের কার্যক্রমকে নানাভাবে ব্যাহত করতে হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণ, জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবী, পেশাজীবী, গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ীসহ দেশের সব বিবেকবান মানুষকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধকল্পে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বছরজুড়ে বিরামহীন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এর আওতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাফল্যও অর্জিত হয়েছে। তবে এতো বিশাল সমুদ্র এলাকায় অন্যান্য বাণিজ্য জাহাজ এবং ফিশিং ট্রলারের মধ্যে র‌্যাডারের মাধ্যমে মানবপাচারকারী ট্রলার খুঁজে বের করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং সমুদ্রপথে মানবপাচারের ক্ষেত্রে কেবল সমুদ্রে প্রতিহত করার ধারণা পোষণ করলে এ ধরনের অবৈধভাবে মানবপাচারের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে রোধ করা সম্ভব নয়। তাই মানবপাচার বন্ধের অভিযানে স্থলভাগে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচারের প্রবণতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হওয়ায় তা রোধকল্পে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মানবপাচারের পরিণতি সম্পর্কে সারাদেশে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানোসহ নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং লেখালেখির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রার ভয়াবহতা তুলে ধরে নিরীহ মানুষ যাতে দালালদের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা না করে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে নিরাপদ নৌযান ব্যতীত সমুদ্রপথে যাত্রার ভয়াবহতার ব্যাপারে যে অজ্ঞতা বিরাজমান তা দূরীকরণের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ডসহ সমুদ্রে চলাচলের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সব মেরিটাইম সংস্থার প্রশিক্ষিত সদস্যদের স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নিজ এলাকার এহেন প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়ার মতো সম্ভাব্য লোকজনকে বিরত রাখার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মানবপাচার প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারের একটি চরম লঙ্ঘন। একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র সুকৌশলে বাংলাদেশব্যাপী নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে প্রতি বছর অনেক নিরীহ মানুষ সমুদ্রে মারা যাচ্ছে বা নিখোঁজ হচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে একত্রে কাজ করে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানবপাচার প্রতিরোধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মানবপাচার একক কোন দেশের উদ্যোগে বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফলে যে দেশ থেকে, যে দেশের মধ্য দিয়ে এবং যে গন্তব্যে মানবপাচার হয়ে থাকে সেই দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই অবৈধভাবে মানবপাচার প্রতিরোধ করতে হবে। অনুরূপভাবে সমুদ্রপথে মানবপাচার রোধে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উপকূলবর্তী এলাকায় ও দেশের সম্ভাব্য সব গুপ্তাশ্রয়ে জোরদার অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অপরদিকে মানবপাচারের প্রধান কারণ সমাজে দরিদ্রতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, বিপুল জনসংখ্যা, আবাসন স্বল্পতা ইত্যাদি বলে বিবেচিত। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সমাজ ও দেশের সমস্যা হিসেবে না ভেবে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সেইদিক বিবেচনায় রেখে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনশক্তি রফতানিতে জোর দিতে হবে। দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারলেই তাদের আর পাসপোর্ট ও ভিসাবিহীন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে না। লেখক : কমান্ডার (ট্যাজ), এএফডব্লিউসি, পিএসসি, বিএন
×