ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনকণ্ঠকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম

‘আমদানির সুযোগ না পেয়ে কৃষক লীগের এক নেতা গম নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন’

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৫ জুন ২০১৫

‘আমদানির সুযোগ না পেয়ে কৃষক লীগের এক নেতা গম নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন’

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গম আমদানির সুযোগ না পেয়েই ‘পচা’ ধুয়ো তুলে আমদানিকৃত ব্রাজিলের গম নিয়ে ইস্যু তৈরি করছে একটি মহল। এই চক্রটি সরকারের পক্ষে গম আমদানির জোরালো প্রচেষ্টা চালায়। এমনকি সরকারের প্রভাবশালী মহলও এই চক্রকে গম আমদানির সুযোগ প্রদানের জন্য তদ্বির করে। বেশি দামে সরকারকে গম গছাতে ব্যর্থ হয়েই তারা আমদানিকৃত ব্রাজিলের গমকে পচা বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে। এমনকি অন্যত্র থেকে পচা ও পোকায় খাওয়া গম বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে আলোড়নও সৃষ্টি করেছে। আমদানিকৃত ব্রাজিলের গম সম্পর্কে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, এটি খাওয়ার অনুপযোগী নয়। এ পর্যন্ত ৩০ নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। এর প্রতিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে গমগুলো খাওয়ার উপযোগী। এছাড়া আরও ২১ নমুনা পরীক্ষা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে জি টু জি ভিত্তিতে গম আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে ২৯৭ দশমিক ৫ ডলার করে রেট নির্ধারণ হয়। এ লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়। এস্টেট ফুড কর্পোরেশন এই গম দেবে বলে চুক্তি হয়। এরপর এটি ক্রয় কমিটিতে পাঠানো হয়। ক্রয় কমিটির অনুমোদনের পর তা ই-মেইলের মাধ্যমে কোম্পানিটিকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই কোম্পানিটি এর কোন প্রতিউত্তর দেয় না। বারবার তাগিদ দেয়াও পরও তারা কোন উত্তর দেয় না। এর ৩-৪ মাস পর ইউক্রেন তাদের পক্ষে পুনরায় আরও একটি এজেন্ট নিয়োগ করে। তাদের প্রতিনিধিরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এতে নতুন দাম নির্ধারণ হয় ২৬১ ডলার করে। এটি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানোর আগে বাংলাদেশের একটি মহল বলে ২৬১ ডলার করে যারা গম দেবে তারা ভুয়া প্রতিষ্ঠান। এরা মূলত গম দেবে না। মন্ত্রী বলেন, তখনই আমাদের সন্দেহ হয় দেশের এই গ্রুপ গম আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিগত আমলে এই গ্রুপই ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করেছিল। এই গ্রুপই অপব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠায়। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অর্থমন্ত্রী চিঠিটি বের করে বলেন, এই চিঠির সত্যতা পাওয়া যায় না তাই আমি আমলে নিলাম না। এই বলে অর্থমন্ত্রী এটি পাস করে দেন এবং আমাকে (খাদ্যমন্ত্রী) উদ্দেশ করে বলেন, ইউক্রেনের গম আনতে দুইবার পাস করে দিলাম। ইউক্রেনের বিষয় আর এনো না। মন্ত্রী বলেন, ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের পর এই চিঠির ভিত্তিতে আমি নিজ উদ্যোগে কোম্পানিটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিলাম। কিন্তু সে উত্তরও পাইনি। খোঁজখবর নিচ্ছি বলেই অনেকটা সময় পার করে দেয়। এদিকে ইউক্রেনের মন্ত্রিসভায় রদবদল এবং উত্তর না দেয়ায় তাদের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি বলেন, পরে জনাতে পারলাম টাঙ্গাইলের এক কৃষক লীগ নেতা এই চক্রের হোতা। বিগত আমলে তিনি গম আমদানি করতেন। তার রেট বেশি হওয়ায় আমরা তাকে দিয়ে গম আমদানি করতে না চাওয়ায় তিনি এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন। এমনিক রাষ্ট্রদূতকেও রিপোর্ট না দেয়ার জন্য ম্যানেজ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এদিকে গমের রিজার্ভ তলানিতে এসে ঠেকে। রিজার্ভ মাত্র ৬৮ মেট্রিক টন হওয়ায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাধ্য হয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে টেন্ডার পায় ইমপেক্স ইন্টারন্যাশনাল এবং ওলাম ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এরা ব্রাজিল থেকে গম আমদানি করে। ব্রাজিলের গম আমদানি করা হলে দেখ যায় গমের দানাটা ছোট এবং গমটা ইউক্রেনের গমের মতো স্বচ্ছ নয়। এছাড়া ব্রাজিলের গম সম্পর্কে আমরা আগে অবহিত ছিলাম না। তিনি বলেন, জাহাজে থাকা অবস্থায় ৫-৬টা পরীক্ষা করা হয়। সব পরীক্ষায় দেখা যায় খাওয়ার উপযোগী গম এসেছে। এমনকি প্রোটিনের মান বেশিও পাওয়া যায়। যেখানে সর্বনিম্ন ১০ মাত্রা থাকার কথা ছিল সেখানে ছিল ১১ দশমিক ৫ মাত্রা। ফেব্রুয়ারিতে এই গম প্রথম আসে। প্রথমে চারটা জাহাজে এই গম আসে। এরপর দেশের সঙ্কট মুহূর্ত কেটে যাওয়ায় এই গম আমদানি নিষেধ করে দেই। এরপর খাদ্য অধিদফতর থেকে ৫ম ও ৬ষ্ঠ প্যাকেজ খালাসের প্রস্তাব পাঠালে তা বাতিল করে দেয়া হয়। এ সময় এই গম আমদানিতে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অতি উৎসাহ দেখালে মন্ত্রণালয় তার ওপর নাখোশ হয়। এরপর মহাপরিচালককে বদলি করা হয়। নতুন মহাপরিচালক আসলে ব্রাজিলের গমের ৭ম প্যাকেজ আসে। তাও বাতিল করে দেয়া হয়। মন্ত্রী বলেন, ফেব্রুয়ারিতে গম আমদানি করা হয়েছে। এর পর চার মাস অতিবাহিত হয়েছে কোন অভিযোগ আসেনি। হঠাৎ করে কেন, কারা, পঁচা গমের নমুনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়? প্রধানমন্ত্রী এই নমুনা দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন। এই খারাপ গম এনেছ কেনÑ এমন প্রশ্ন করায় আমি বলি, এটি ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম নয় বলে মনে হচ্ছে। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই গম কোন গোডাউন থেকে এসেছে? কিভাবে বাজারে এসেছেÑ খুঁজে বের কর। তিনি বলেন, আমরা তখন সকল ডিসিকে চিঠি দেই এবং ডিজি অফিস থেকে নিয়ে যে সকল গোডাউনে ব্রাজিলের গম আছে তার তালিকা পাঠিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তার নমুনা সংগ্রহ করতে বলি। এ নমুনা থেকে ৩০টির পরীক্ষা রিপোর্ট আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। আরও ২১টি পরীক্ষাধীন রয়েছে। এই ৩০টি রিপোর্টেই বলা হয়ছে আমদানিকৃত এই গম খাওয়ার অনুপযোগী নয়। অর্থাৎ এটি খাওয়ার উপযোগী। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, পত্রিকায় যে সকল গমের ছবি ছাপানো হয়েছে তা আমাদের আমদানিকৃত গমের ছবি নয়। তিনি বলেন, ব্রাজিলের গম ‘পচা’ ধুয়ো তুলে ইস্যু তৈরির চেষ্টা চালিয়ে এখন ওই চক্র ইউক্রেন থেকে প্রতি স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের কপি এনে ব্যবসা করতে চাচ্ছে। তারা বলছে, ২৯৭ দশমিক ৫ ডলারে গম দেবে তারা। কিন্তু আমরা বলেছি তোমাদের কাছ থেকে বেশি দামে গম কেন নেব। ইউক্রেনের এক কোম্পানি ২৬১ ডলার করে দিতে চেয়েছে। তাদের (চক্র) কাছ থেকে গম না নেয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করছে এবং তাদের কাছ থেকে গম নেয়ার জন্য তদ্বির করছে। ব্যারিস্টার রফিকুল হককে দিয়ে উকিল নোটিসও পাঠিয়েছে ইউক্রেনের সঙ্গে গমের চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। এমনকি এই চক্র ফ্রান্সের গমও পচা আখ্যায়িত একটি পত্রিকায় রিপোর্ট করিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ॥ এদিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গমের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় তাদের লিখিত বক্তব্য দিয়েছে। উপসচিব মোঃ কাউসার আহমেদ স্বাক্ষরিত এ বক্তব্য হলোÑ পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক উৎস হতে গম ক্রয়ের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়। কোন দেশের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করে গম আমদানি করা হয়নি। সরকারী বিধান অনুযায়ী ইসরাইল ব্যতীত যে কোন দেশ থেকে দরদাতা কর্তৃক এই গম সরবরাহ করার সুযোগ রয়েছে। গম বন্দরে পৌঁছার পর চুক্তির শর্ত মোতাবেক ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে থাকলে গম গ্রহণ করা হয়। টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী আগত ব্রাজিলীয় গম বিনির্দেশ মোতাবেক গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে থাকায় তা গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গম নিয়ে বিরূপ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সারাদেশ থেকে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে সিলগালাবস্থায় গমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। অতপর ল্যাবরেটরিতে পুনরায় টেস্ট করানো হয়। ব্রাজিল থেকে আগত ওই গম চুক্তিতে বর্ণিত বিনির্দেশ মোতাবেক পাওয়া গেছে। টেস্ট রিপোর্টে পচা কিংবা মানুষের খাবার অনুপোযোগী কোন গম পাওয়া যায়নি।
×