ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নায়েক রাজ্জাককে আজই ফেরত দেবে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৫ জুন ২০১৫

নায়েক রাজ্জাককে আজই ফেরত দেবে মিয়ানমার

তৌহিদুর রহমান/এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আজই দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠক শুরু হচ্ছে। ওই বৈঠকে নায়েক রাজ্জাককে হাজির করা হবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সীমান্ত শহর মংডুতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক হবে। পতাকা বৈঠকের মধ্য দিয়ে নায়েক রাজ্জাককে দেশে ফিরিয়ে নানা সম্ভব হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নায়েক রাজ্জাকের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। তবে কয়েক দফা চেষ্টার পর অবশেষে বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে মিয়ানমার। দেশটির কাছে ইতোমধ্যেই বিজিবির ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নামও পাঠানো হয়েছে। বৈঠকের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষই বাংলাদেশকে জানিয়েছে। মংডুতে অনুষ্ঠিতব্য দুই দেশের মধ্যে এই বৈঠকে নায়েক রাজ্জাককে হাজির করবে মিয়ানমার। বৈঠকে নায়েক রাজ্জাককে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্তের পর দুই দেশের সীমান্তে বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। সূত্র জানায়, কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ। সে লক্ষ্যেই বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের আশ্রয়ে থাকা নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আলাদাভাবেই বিবেচনা করতে চায় বাংলাদেশ। নায়েক রাজ্জাক ও মিয়ানমারের আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি পুরোপুরি আলাদাভাবেই দেখা হচ্ছে। এদিকে বুধবার রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরে মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনতে পতাকা বৈঠকে যোগ দিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাচ্ছে। তিনি বলেন, আশা করছি, পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে খুব শীঘ্রই রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনতে পারব। বিজিবির ডিজি বলেন, ঘটনার পর পর বিষয়টি আমাকে জানানো হয়। আমি কমান্ডারদের নির্দেশনা দিয়েছি। কূটনৈতিকভাবে ও বিজিপির সঙ্গে আমাদের চুক্তির কথা উল্লেখ করেও এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। মিয়ানমারও বিভিন্নভাবে আশ্বাস দিয়েছে। তাদের আশ্বাসে মনে হচ্ছে, দ্রুত রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনতে পারব। তিনি আরও বলেন, বিজিপির পক্ষ থেকে রাজ্জাকের সুস্থতার কথা প্রথমে আমাদের জানানো হয়েছিল। পরে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করা হয়। আমরা এ জন্য প্রতিবাদ জানিয়েছি। শুনেছি রাজ্জাককে নিয়ে যাওয়ার আগে হাতাহাতি হয়েছে। তবে কিভাবে রাজ্জাকের নাক থেকে রক্ত বের হয়েছে তা সে এলে জানা যাবে। ঘটনার প্রথম থেকেই রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এখনও আছে এবং তাঁকে ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটকের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নায়েক আবদুর রাজ্জাককে মুক্তি দেয়নি মিয়ানমার। তবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে তাদের দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করেছেন নায়েক আবদুর রাজ্জাক। দেশটির অভিযোগ জলসীমানার এক কিলোমিটার ভেতরে অনুপ্রবেশ করেছেন তিনি। আর এই অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য রাজ্জাককে আটকে রেখেছে দেশটি। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের জলসীমায় রাজ্জাকের অনুপ্রবেশের অভিযোগ সঠিক নয়। নায়েক রাজ্জাককে বাংলাদেশের জলসীমা থেকেই তুলে নিয়ে গেছে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান দেশটির পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নেপিডোতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানান, বিষয়টি তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদারকি করছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সমাধান করতে চায়। গত ১৭ জুন ভোরে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা নায়েক রাজ্জাককে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে তোলপাড় শুরু হয়। ১৮ জুন রাতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। সে সময় নায়েক আবদুর রাজ্জাককে দ্রুত ফেরত দেয়ার দাবি জানানো হয়। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থান সে সময় নায়েক রাজ্জাককে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাসও দেন। এদিকে ১৯ জুন ঘুমধুম সীমান্ত বরাবর দেশটির ঢেকিবনিয়ায় দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিজিপি কর্মকর্তারা অতি দ্রুত নায়েক রাজ্জাককে ফেরত দেবে বলে বিজিবি কর্মকর্তাদের আশ্বাস দেয়। তবে সেই আশ্বাস দেয়ার পরেও কোন কাজ হয়নি। এছাড়া বিজিবির পক্ষ থেকে পতাকা বৈঠকে বসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদিকে মিয়ানমারের হাতে আটক নায়েক আবদুর রাজ্জাকের বিভিন্ন ছবি ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছে। এ নিয়ে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকেই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করছেন এবং আটক সীমান্তরক্ষীর সঙ্গে অবমাননাকর আচরণের অভিযোগ তুলছেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে শেয়ার করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে আবদুর রাজ্জাককে হাতকড়া পরানো অবস্থায় একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর পরনে লুঙ্গি আর বিজিবির ইউনিফর্ম। আরেকটি ছবিতে দেখা যায় তাঁর সামনে কিছু অস্ত্র রাখা। রাজ্জাকের মুখে আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট একটি সংবাদপত্র মাযাওযাদিতে ছবিটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেশী একটি দেশের একজন সীমান্তরক্ষীকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ যে আচরণ করেছে তাকে বাংলাদেশের অনেকেই অবমাননাকর এবং চরম আপত্তিকর বলে মনে করছেন। পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে বিজিপির পক্ষে বিজিবির কাছে পত্র পাঠানো হয়। পত্র পাওয়ার পর বিজিবি সদর দফতরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ কাক্সিক্ষত এ পতাকা বৈঠকে যোগ দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন টেকনাফ বিজিবি ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। পক্ষান্তরে, ওই বৈঠকে বিজিপির পক্ষে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন সে দেশের ২নং ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল থিন কো কো। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড অব পুলিশের (বিজিপি) পক্ষ থেকে বিজিবির কাছে প্রেরিত একটি চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের তালিকা চাওয়া হয়। বিজিবি তালিকাটি তৎক্ষণাৎ মিয়ানমারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। এরপর পতাকা বৈঠকে বসতে সম্মতি জানিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ৪২ বিজিবি সদর দফতরে চিঠি পাঠায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। চিঠিতে রাজ্জাককে ফেরতের বিষয়ে পতাকা বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণ ও বিজিবির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নাম জানাতে বলা হয়। কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আনিসুর রহমান জানান, মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ ২ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল থিন কো কো স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার পরে পৌঁছে। চিঠিতে নায়েক রাজ্জাককে ফেরতের বিষয়ে পতাকা বৈঠকের জন্য দিন, তারিখ নির্ধারণের পাশাপাশি পাঁচ সদস্যের বিজিবির প্রতিনিধি দলে কারা থাকবেন তা জানাতে বলা হয়। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি কর্তৃক অপহৃত বিজিবির নায়েক রাজ্জাককে ফিরে আনতে পতাকা বৈঠকে যোগদানের জন্য ৫ বিজিবি সদস্যের তালিকা মিয়ানমারে পাঠিয়েছে বিজিবি। বুধবার সকালে ৬ সদস্যের বিজিবি প্রতিনিধি দলের তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক দফতর সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।
×