ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তান গ্রহণে সচেতনতা বেড়েছে ॥ জন্মহার কমেছে গ্রামে

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২৪ জুন ২০১৫

সন্তান গ্রহণে সচেতনতা বেড়েছে ॥ জন্মহার কমেছে গ্রামে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ সন্তান গ্রহণে সচেতনতা বাড়ছে মানুষের। মোট প্রজনন হার (১৫-৪৯ বছর বয়সের মধ্যে) জাতীয়ভাবে কমে দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক এগার শতাংশ, যা ২০০৯ সালে ছিল দুই দশমিক পনের শতাংশ। এ হার ২০১১ সালে দুই দশমিক এগার শতাংশ থাকলেও ২০১০ সালে ছিল দুই দশমিক বার শতাংশ। তবে গ্রামে সন্তান নেয়ার হার কমলেও কিছুটা বেড়েছে শহরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর মনিটরিং দি সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্টাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ -২০১৩ প্রকল্পের প্রতিবেদনের এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। সন্তান গ্রহণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে সচেতনতা, চাকরিজীবী দম্পত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সচেতনতা এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এখন যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে এতে করে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২২ থেকে ২৪ কোটির মতো হবে। সেটি আবার ২১০০ সালে গিয়ে কমতে শুরু করবে। সে সময় ১৫ কোটিতে চলে আসবে। আড়াইশ বছর পর দেখা যাবে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের সময় দেশের জনসংখ্যা যেরকম ছিল সেরকম পর্যায়ে নেমে আসবে। তখন বাংলাদেশ হবে আধুনিক শিল্পোন্নত দেশ। এখন মানুষের মধ্যে সন্তান জন্ম নেয়ার বিষয়ে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি অত্যন্ত পজেটিভ। এটি সরকারগুলোর দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল। এক্ষত্রে এনজিও, উন্নয়নসহযোগী সংস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জার্মানিতে এখন সন্তান জন্ম হচ্ছে কম। সেটি সেখানকার বিষয়। এটি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আড়াইশ বছর পর তখন যারা এদেশে বাস করবে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে তখন সন্তান নেয়া বাড়াবে নাকি কমাবে। পসিংখ্যান ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গ্রামে প্রজনন হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। তবে প্রজনন হার বেড়েছে শহর এলাকায়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রামে ২০১৩ সালে প্রজনন হার কমে দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক উনিশ শতাংশে, যা ২০১২ সালে ছিল দুই দশমিক ত্রিশ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল দুই দশমিক পঁচিশ শতাংশ, ২০১০ সালে ছিল দুই দশমিক ছাব্বিশ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ছিল দুই দশমিক আটাশ শতাংশ। অন্যদিকে শহর এলাকার চিত্র ভিন্ন। শহরে ২০১৩ সালে প্রজনন হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক দশমিক সাতাশি শতাংশ, যা ২০১২ সালে ছিল এক দশমিক চুরাশি শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল এক দশমিক একাত্তর শতাংশ, ২০১০ সালে এক দশমিক বাহাত্তর শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ছিল এক দশমিক পঁয়শট্টি শতাংশ। শহরে সন্তান গ্রহণের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, যত বেশি নগরায়ন হচ্ছে ততই বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। এ বস্তিগুলোর এখনো অশিক্ষা-কুশিক্ষা রয়েছে। তাছাড়া সচেতনতার অভাবও যথেষ্ট রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাপারোস্কপিক সার্জন ডাঃ রেজাউল করিম কাজল জানান, মূলত তিন কারণেই দেশে প্রজনন হার কমছে। এগুলো হচ্ছে প্রথমত, শিক্ষার হার বাড়ছে। এজন্য মানুষ সচেতন হয়েছে। তারা মনে করছে পরিবারে জনসংখ্যা কম রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে এবং তৃতীয়ত, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী আলাদা থাকছে কেন না দু’জনে চাকরি করেন। তাছাড়া কর্মজীবী নারীরা মনে করছেন একটির বেশি সন্তান নিলে তাদের ব্যবস্থাপনার সমস্যা হবে। এসব কারণেই প্রধানত প্রজনন হার কমছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডাঃ কাজল বলেন, প্রজনন হার কমতে থাকলে ভবিষ্যতে কাজের লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখনই বাসায় কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এক সময় যখন দু’জন মারা যাবে এবং দু’জন জন্ম নেবে এই জন্ম ও মৃত্যুর হার সমান সমান হবে তখন আমাদের দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজের লোকের সঙ্কট দেখা দেবে। যেমন মালয়েশিয়া এখন বিদেশ থেকে লোক নিচ্ছে। আগামীতে আমাদের যদি বিদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে কাজ করাতে হয় তাহলে সমস্যায় পড়তে হবে। এজন্য এখন থেকে পরিকল্পিতভাবে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাধারণ প্রজনন হারও (যেকোন বয়সের নারী ও পুরুষের) কমেছে। ২০১৩ সালে এ হার দাঁড়িয়েছে একাত্তর শতাংশ, যা ২০০৯ সালে ছিল বাহাত্তর শতাংশ। গ্রামে ২০১৩ সালে প্রজনন হার দাঁড়িয়েছে ছিয়াত্তর শতাংশ, যা ২০০৯ সালে ছিল সাতাত্তর শতাংশ। অন্যদিকে শহর এলাকায় ২০১৩ সালে প্রজনন হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে বাষট্টি শতাংশ, যা ২০০৯ সালে ছিল সাতান্ন শতাংশ। প্রতিবেদন বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক একেএম আশরাফুল হক বলেন, প্রজনন হার কমা মানে সন্তান জন্ম দানের সক্ষমতা কমা নয়। এর অর্থ হচ্ছে মানুষের সন্তান নেয়ার হার কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৮০ সাল হতে আন্তঃশুমারি সময়ের জনতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের জন্য এ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে ১৫০০টি নমুনা এলাকায় এ কার্যক্রম চলছে, যেখানে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পরিবার হতে নিয়মিত জনতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়ে খানার সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক ৫ জন এর ফলে প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার জন এ প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহের আওতায় নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। বর্তমানে তথ্যের গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য আরও ৫১২টি নমুনা এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এ বছর থেকেই তার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মীর্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। তার স্ত্রী একটি বেসরকারী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাদের দুটি ছেলে রয়েছে। পরবর্তীতে একটি মেয়ে নেয়ার জন্য তার স্ত্রী তাকে চাপ দিলেও তিনি এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাননি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট। তাছাড়া আমরা দু’জনই চাকরিজীবী। বর্তমান দুটি সন্তানেরই ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারছি না। আর একটি হলেতো নানা দিক থেকেই সমস্যা দেখা দেবে। তিনি জানান, তার ছোট ভাই মীর্জা মোঃ নিজাম উদ্দিনও একটি বেসরকারী হাইস্কুলের শিক্ষক এবং তা স্ত্রী সরকারী প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তাদের একটি মাত্র মেয়ে। তারা আর একটি সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা মোট ছয় ভাইবোন এবং তার বাবা ও চাচারা ৫ ভাইবোন। কিন্তু আমরা সচেতন। আর্থিক পরিস্থিতি ভাল থাকলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। মীর্জা নাসির উদ্দিনের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের ডাইরপাড়া গ্রামে।
×