ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৪ জুন ২০১৫

গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন

বাকস্বাধীনতা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। এটা জনস্বার্থে জনগণের মাঝে বিভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময় মতামত পরিবেশনে উৎসাহ দেয়। কিন্তু সব ধরনের স্বাধীনতার মতো এটা শর্তহীন নয় এবং সেটা উচিতও নয়। বাকস্বাধীনতা একদিকে অন্য কারও প্রতি ঘৃণা প্রকাশের সম্ভাব্য অস্থিতিশীল প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং অন্যদিকে অন্যের আবেগ বা অনুভূতিকে যেন আঘাত না করে সে ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণতা বজায় রেখে করা দরকার। উপরন্তু, কানাডিয়ান বিচারপতি এমএ বাইন্ডারের ভাষায়, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিচারিক আদালতের মর্যাদা এবং অখণ্ডতার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’ গত বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অফিসিয়াল মৃতের সংখ্যা চ্যালেঞ্জ করে ইতিহাসকে অবমাননার অপরাধে ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী এক সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে। মাননীয় বিচারক বার্গম্যানের ২০১১ সালের একটি ব্লগ পোস্টে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ২০১১ সালের নবেম্বর দেয়া ঐ পোস্টে তিনি মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে মতামত দেন এবং সরকারী সংখ্যার সমর্থনে কোন প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করেন। ট্রাইব্যুনালের প্রিসাইডিং বিচারক ওবায়দুল হাসান ডেভিড বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়া তাঁর রায়ে বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরল বিশ্বাসে এবং জনস্বার্থে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডেভিড বার্গম্যানের তন্নতন্ন করে খুঁজে এ সংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করার পেছনে সরল বিশ্বাস ছিল না এবং এটা তিনি জনস্বার্থ রক্ষার জন্য করেননি।’ ট্রাইব্যুনাল পুনর্ব্যক্ত করে, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং এটা বাংলাদেশের জনগণের ‘আবেগের সঙ্গে জড়িত’। এছাড়াও এই সংখ্যা (৩০ লাখ) ট্রাইব্যুনালের দেয়া আগের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে ট্রাইবুনাল। ‘যে কেউ এই গবেষণা করতে পারেন; কিন্তু ট্রাইব্যুনালের মর্যাদায় আঘাত হতে পারে এমন ধরনের কোন মন্তব্য করার ব্যাপারে তাদের সচেতন হতে হবে’Ñ মাননীয় বিচারক যোগ করেন। তার প্রতিক্রিয়ায় বার্গম্যান আইসিটি অর্ডার তার ‘বাকস্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক যাচাই-বাছাই করতে আগ্রহী তাদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় বলে আখ্যায়িত করে’ বলেন, তিনি এ আদেশে ‘মর্মাহত’। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে বার্গম্যানের শাস্তি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে বলে ৫০ জন নাগরিক এক বিবৃতি প্রদান করেন। এ বছরের ১৪ জানুয়ারি আইসিটি-২ আদালত অবমাননার জন্য ডেভিড বার্গম্যানের আদালত অবমাননার শাস্তির ওপর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করে। আদালত তার আদেশে ‘ট্রাইব্যুনালের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা জনগণের সামনে এবং মনে খর্ব করার জন্য এ বিবৃতি দেয়া হয়েছে’ বলে উল্লেখ করে। আদালতের দৃষ্টিতে আরও মনে হয়েছে, এ বিবৃতিটি ‘ট্রাইব্যুনালের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং বার্গম্যানের শাস্তি দেয়ার আদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্না তোলা হয়েছে।’ ট্রাইব্যুনাল ২৬ জন বিবৃতিদাতা নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়ায় তাদের অভিযোগ হতে অব্যাহতি দেয়। অন্য ২২ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় যেহেতু তারা প্রথমবারের মতো আদালত অবমাননা করেছিলেন। তবে আইসিটি জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে, ১৯৭১ সালে ঘটনাক্রমে যিনি ইতিহাসের সঠিক দিকে অবস্থান নিয়েছিলেন, ডেভিড বার্গম্যানের শাস্তির সমালোচনা করে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এক ঘণ্টার জন্য আদালতেই গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদান করে এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে এবং অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাজার পর আদালতে তিনি যে চরম অভদ্রতার প্রকাশ ঘটান এবং বিবৃতিতে প্রায় সব স্বাক্ষরদাতাই বার্গম্যানের ব্লগে কিভাবে আমাদের শহীদের সংখ্যা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, তিনি কিভাবে ট্রাইব্যুনালকে উপদেশ দিয়েছেন, তাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয় (ভাবখানা বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ কলোনি) এবং বার্গম্যানের সাজার রায় না পড়ে এবং সেটা বিন্দুমাত্র না জেনেই ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ সপক্ষে বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং ইউরোপের ১৪টি দেশে ‘হলোকস্ট অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’-এর মতো ‘গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’ প্রণয়নের দাবি ওঠে। ঐ আইন অনুযায়ী ১৯৩০ এবং ১৯৪০ সালে নাৎসি জার্মানি ইউরোপে সুপরিকল্পিত জাতিগত সংখ্যালঘুদের লাখ লাখ মানুষ নিধনকারী গণহত্যাকে অস্বীকার করা আইনের লঙ্ঘন। অনেক দেশে গণহত্যা অস্বীকারকে অপরাধ গণ্য করে বৃহত্তর আইন হয়েছে। বেলজিয়ামে হলোকস্ট অস্বীকার করা ১৯৯৫ সালে অবৈধ হয়েছে। আইনে শর্ত দেয়া হয়েছে, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শাসকদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা অস্বীকার করা, ছোট করা বা ন্যায্যতা দেয়ার প্রচেষ্টা যে কেউ করলে সে ব্যক্তি জেল দ্বারা দণ্ডিত হবেন।’ ১৯৯০ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সে গ্যাসট এ্যাক্ট নামের এক আইন অনুযায়ী নাৎসি নেতাদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, সে অপরাধের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা সেদেশের আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয়। জার্মানিতে ‘প্রকাশ্যে বা জনসভায় জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের শাসনাধীনে সংঘটিত অপরাধকে অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদন দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।’ হাঙ্গেরীর সংসদ হলোকস্ট অস্বীকার বা লঘুকরণের প্রচেষ্টার অপরাধকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদ-ের অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সরাসরি হলোকস্ট অস্বীকার নিষিদ্ধ না হয়ে থাকলেও গণহত্যা অস্বীকার, লঘুকরণের প্রচেষ্টা বা অনুমোদনের অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান সব সদস্য রাষ্ট্রের ঐচ্ছিকরূপে প্রয়োগ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিছু মানুষ বাকস্বাধীনতার নামে কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে। তারা এক অসৎ উদ্দেশ্যে আমাদের ত্যাগ এবং উৎসর্গকে লঘুকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে সুচতুরভাবে আমাদের জনগণের ওপর সংঘটিত অপরাধকে যৌক্তিকতা দানের প্রয়াসে প্রয়াসী। এটা আইসিটির মর্যাদা কমিয়ে এর বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার এক দুষ্ট অভিপ্রায়ও বটে। বর্তমান সরকার জনসাধারণের এক দীর্ঘ লালিত চাহিদার প্রতিফলন ঘটিয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের জনগণের ওপর সংঘটিত গণহত্যার বিচার চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে জনগণের ‘আবেগ লালিত’ দাবি ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রণীত ‘হলোকস্ট অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’-এর আদলে ‘গণহত্যা অস্বীকারের বিরুদ্ধে আইন’ প্রণয়ন করবে, যাতে করে ভবিষ্যতে আমাদের শহীদের সংখ্যা এবং ত্যাগকে কেউ অস্বীকার বা লঘু করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত না হতে পারে। এ প্রস্তাবিত আইন একই সঙ্গে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে এক বিরাট ঢাল হিসেবে কাজ করবে এবং সেটা শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য আমাদের গৌরবময় এবং স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের শান্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠা করবে। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×