ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শরীফা খন্দকার

তুমি করলে বিশ্ব জয় এ কী বিস্ময়!

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৪ জুন ২০১৫

তুমি করলে বিশ্ব জয় এ কী বিস্ময়!

জীবনে প্রথমবার ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলতে নেমে ভারতের মতো জ্যোতিস্ক খচিত দলের বিরুদ্ধে পাঁচ ও দ্বিতীয় ম্যাচে ছয়টি উইকেট নিয়ে মাত্র উনিশ বছরের মুস্তাফিজুর রহমানের বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টিতে অত্যন্ত হতবাক হয়ে গেছে ক্রিকেট দুনিয়া। আর সমগ্র দেশবাসীসহ আমরা যারা প্রবাসী মানুষ, তারা আশ্চর্য স্বপ্ন পূরণের উন্মাতাল আনন্দে ভেসে গেছি আসমুদ্র হিমাচল। ১৯৭১ সালে একদিন এই বিস্ময়ের প্রতীক্ষাতেই বুঝি ছিল দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর রক্তে ভেজা ৫৪ হাজার বর্গমাইলের কালো পোড়ামাটি। কিন্তু আজকের অবিশ্বাস্য দিনের এসব স্বপ্ন দেখানোর আশ্চর্য যাদুকরকে রং তুলি ফেলে হারিয়ে যেতে হয়েছিল কোন অবেলায়। এক সময় এমনটা ভেবে কূল পাইনি যে, আমাদের সেই স্বপ্ন কি হারিয়ে যাওয়ার জন্য রচিত হয়েছিল? তার অফুরান বর্ণগন্ধ কি লুকিয়ে নেই কুসুমে কুসুমে, পত্রপল্লবে, সমুদ্রের গর্জনে, নদীর বহতা স্রোতধারার কোথাও? কিন্তু জীবনের একটা সময়ে দেখলাম আসলে স্বপ্নরা বারবার ফিরে আসে! সেই ফেরার চরণ চিহ্ন হয়ে তুই এলি উনিশ বছরের এক বিস্ময় বালক! ‘বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্ব জয় এ কী গো বিস্ময়।’ শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ কাকে উদ্দেশ করে যে এমন গান রচনা করেছিলেন, জানি না। কিন্তু কবির গানকেও ফিরে আসতে হয় যুগে যুগে! আজ ক্রিকেটের নানা আনন্দময় খবর পড়তে গিয়ে যখন শুনছিলাম সেই গানটি, তখন এই কথাটাই মনে হলো কেবল আজকের উনিশ বছরের সবার প্রিয় বালকবীরের জন্যই যেন কবির এমন গান লেখা- গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী, কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী। তরুণ হাসির আড়ালে কোন্ আগুন ঢাকা রয়... এ কী গো বিস্ময়। একটি সংবাদ সম্মেলনের ভিডিওতে তোর মতো এমন ছেলেকে দেখা ও শোনা কম অবাক করা নয়। অভূতপূর্ব সারল্যের এমন প্রতিমূর্তি কে কবে দেখেছে বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে? স্থবির কে না হয়েছে যারা শুনেছে উনিশেই বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টিকারী ছেলেটি জেলা শহরে খেলতে আসার আগে ক্রিকেটের কাঠের বলটি পর্যন্ত ধরা-ছোঁয়ার আওতায় পায়নি, খেলেছে টেনিস বল দিয়ে! তার জেদের সঙ্গে না পেরে মেজ ভাই তাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে প্রতিদিন ভোর বেলা ৪৫ মাইল দূরে নিয়ে যেতেন প্রাকটিসে। ওর কথা শুনতে গিয়ে, ইংরেজী না বোঝা নিয়ে আদরে ভালবাসায় উদ্বেলিত হয়ে উঠছিলাম বারবার। চুলটা ঘেঁটে দিতে দিতে গভীর বেদনায় বলতে চাইলাম, তুই আমাদের সেই মেয়েটির ছেলে যে তার মুখের সমস্ত নগরীর কারুকার্য বিলিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার পায়ে। আমার মতো আরও কারও কারও ছেলে তুই, যারা ভয়ার্ত মধ্যরাতে অন্তহীন বেদনায় বাড়ির টিনের চাল থেকে খুলে পালিয়েছিল নিজ হাতে তৈরি করা লাল আর সবুজ এক পতাকা। যেটা লুকিয়ে ছিল হৃদয়ের নিভৃত কোণে, নয়টি মাসের অফুরান সুতোর গুটির ভেতর। আজ ঢাকা শহরের রাতের রোশনাই আর উল্লাসধ্বনির ভেতর আকাশে-বাতাসে সেই পতাকার বর্ণিল উৎসব থেকে অনেক দূরে আছি। তারপরেও কেমন এক পরম আশ্চর্যের প্রাপ্তি মনে হয়! কি আনন্দ এই তো সেদিন- চুন সাদা পানি দিয়ে বাংলার মাঠে পাকিস্তানী শ্বেতহস্তিদের স্নান করাল আমাদের ছেলেরা! ওরাই তো সেই অহঙ্কারী দানব যারা তাদের শাসন শোষণে জর্জরিত করতে করতে সে সময় আমাদের বলেছে, কুৎসিত, নীচু জাত, আমাদের ভাষাকে বলেছে অনার্য। ক্রিকেট তো ছিল ঐসব ফর্সা রঙের রাজা রাজরাদের খেলা- অচ্ছুত কালো বাঙালীরা কোনদিন ঠাঁই পায়নি সেখানে। সে ইতিহাস হয়ত তোর ছোট্ট কানে আজও যায়নি। তারপরেও কি অবাক করা কাণ্ড তুই আমাদের আর এক কালো ছেলে মাত্র উনিশ বছরেই যার টি২০-তে অভিষেক হলো ওদের বিরুদ্ধে ভয়ানক এক লড়াইয়ের ময়দানে? পত্রিকার পাতায় দেখলাম এক নতুন বালকসম ছোট্ট মুখ। যদিও ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা- এই সাকিবরা আমাদের জন্য উপহার হয়ে এসেছে বারবার। তারা গর্বে ভরে দিয়েছে দেশবাসীর বুক। ওরা যখন ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় হিমালয়ের চূড়ার দিকে, আমরা গগন ভরিয়ে চিৎকার করি- শাবাশ বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই টি২০ থেকেই মুস্তাফিজ নামের আমাদের ছেলেটি তুই, যার সংবাদ শিরোনাম শুরু হওয়া। সবাই বলল সে নাকি এক বিস্ময়। কিন্তু সেটা একটুখানি, নাকি অনেক, তখন তার কিছু কি জানি নাকি আমরা। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটের সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতায় কৈশোর ছাড়ানো এক উনিশের ছেলে ঢাকার মাঠে ভারতের বিরুদ্ধে যা ঘটাল, সেটা তো শুধু বিস্ময় নয়। সবাই জানে, তুই মুস্তাফিজ দুয়ার খুলে দিলি এক কিংবদন্তি অধ্যায়ের। ওয়ানডে ক্রিকেটে যে আশ্চর্য ইতিহাস তুই গড়ে গেলি তাতে শুধু আমরা নই, সারা ক্রিকেটবিশ্ব মুগ্ধ স্তম্ভিত। ধোনির মতো ময়দান কাঁপানো এক ক্যাপ্টেন, এক ক্রিকেটার অচেনা ছোট্ট এক হিরন্ময় কাটারীর ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে কিভাবে প্রতিধ্বনিতে পরিণত হলেন, সেটাও গাঁথা হয়ে থাকল ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। তোর হাতে ঢাকার আকাশে উজ্জ্ব¡ল জ্যোতিস্কদের একেকটি পতন যেন নীরব উল্কাপাত! সাতক্ষীরার কোন অচিনপুর গ্রাম তেঁতুলিয়ার এক বালক তুই। মনের চোখে দেখি মেজ ভাই, সাতক্ষীরার রাস্তা, মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ৪৭ মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছে এক ক্ষুদে বালক। যে বালকের সে সময় ক্রিকেটের কাঠের বলটুকু ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্যটুকু হয়নি। কিন্তু কি অসম্ভব কা- ঘটছে এখন, আজ সে ছুঁয়ে দিলেই ক্রিকেটের একেকটি কাঠের বলই হয়ে ওঠে সৌভাগ্যের বরপুত্র। লেখিকা : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×