ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাপাতির আওতায় মুনতাসীর মামুন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৪ জুন ২০১৫

চাপাতির আওতায় মুনতাসীর মামুন

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, জনপ্রিয় কলাম লেখক, সুুপ্রতিষ্ঠিত গবেষক ড. মুনতাসীর মামুনের নামে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ইসলামের কাল্পনিক শত্রু হিসেবে খাড়া করে তাকে হত্যার আওতায় আনার চেষ্টা করছে জঙ্গী মৌলবাদীরা। ১৩ জুন তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠ এমন খবরই পরিবেশন করেছে। বলা হচ্ছে, দেশ টিভিতে নাকি ড. মামুন ইসলামকে কটাক্ষ করে টকশো দিয়েছেন। এই অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা, তার অনুপুঙ্খ প্রমাণ হাজির করে জনকণ্ঠ অনতিদীর্ঘ খবরটি প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য আজকাল মৌলবাদীরা ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীকে এক জায়গায় এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। ইসলামে বলা হয়েছে, ‘প-িতের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।’ এ কথা মৌলবাদী ও জামায়াতীরা হরহামেশা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক প্রত্যেক লেখককে তারা ইসলামের শত্রু প্রতিপন্ন করছে, তাদের মাথার ওপর হত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছে, তাদের নাস্তিক ও মুরতাদ তকমা দেয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে। আমি আজ ২০ বছর ধরে ড. মুনতাসীর মামুনের লেখা পড়ছি। কোথাও পাইনি তিনি ইসলামকে কটাক্ষ করে কোন লেখা লিখেছেন। তারপরও উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, কলামিস্ট মুনতাসীর মামুনকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন ফেসবুক লিংকে বলা হচ্ছে বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেল দেশ টিভিতে ‘ধর্ম ও রাজনীতি’ টকশোতে তিনি পবিত্র ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করে বক্তব্য রেখেছেন। অথচ এই নামে দেশ টিভিতে কোন অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়নি। স্বয়ং দেশ টিভি কর্তৃপক্ষ এই জলজ্যান্ত মিথ্যার দায় অস্বীকার করেছে। ড. মামুন বলেছেন, আমি রাত ১০টার পরে টকশোতে যাই না। আমি কারও ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত করে কিছু বলার পক্ষপাতী নই। শুধু যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবাদবিরোধীদের ব্যাপারে টকশো দিয়ে থাকি। ইসলামকে যারা দলীয়, গোত্রীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য করেছে, ব্যবসার হাতিয়ার করেছে, প্রতিহিংসার ও ক্রোধ নিবারণের মাধ্যম করেছে, তারা ইসলামের নামে মিথ্যাচার করতে বিচলিত হচ্ছে না। ইসলামের নাম ব্যবহার করে আজ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে কী হচ্ছে? পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নাইজেরিয়ায় কী হচ্ছে? তথাকথিত আইএস ও বোকোহারাম কী জঘন্য নরমেধযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসলামের নামে! ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের দোসর জামায়াতে ইসলামী কী নারকীয়, পাশবিক ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ইসলামের নামে! জামায়াতীরাই ধীরে ধীরে এই পরিভাষা, এই প্যারাডক্স তৈরি করেছে যে, ‘যারা মওদুদবাদী ও ওহাবী না হবে তারাই বধযোগ্য, তারাই চাপাতির আওতায় আসবে।’ ড. মুনতাসীর মামুনকেও চাপাতির আওতায় ফেলা হয়েছে। অথচ সমাজের অভ্যন্তরে এরা অনেকেই ন্যক্কারজনক কাজ করে যাচ্ছে, সেদিকে মৌলবাদী, ইসলাম দরদীরা চোখ মেলে তাকায় না। ১ জুন (১৫) তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তার শিরোনাম ছিল ‘ইমামের একি কা-!’ পুরো খবরে বলা হয়েছিল ‘মাদারীপুর সদর উপজেলার চরঘুনসি গ্রামে এক ইমামের বিরুদ্ধে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিশুটিকে গুরুতর অবস্থায় রবিবার সকালে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে ধর্ষক পলাতক রয়েছেন। জানা গেছে, শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চরঘুনসি গ্রামের হাওলাদারবাড়ি জামে মসজিদের ইমামের কাছে আরবি পড়তে যায় চরঘুনসি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ওই ছাত্রী। আরবি পড়া শেষে ইমাম শিশুটিকে মসজিদ ঝাড়ু দিতে বলেন। শিশুটিকে একা পেয়ে তিনি মসজিদের সঙ্গে লাগানো বারান্দায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুখ বেঁধে ধর্ষণ করেন।’ ইসলাম দরদীরা এসব খবর পড়েন না? খোদ মসজিদের বারান্দায় ৭ বছরের অবুঝ বালিকাকে মুখ বেঁধে ধর্ষণ করল মসজিদের তথাকথিত এক ইমাম। কেমন লাগে এসব খবর পড়তে? এসব পাশবিকতার প্রতিবাদ নেই কেন? নাকি কপালে ইসলামের সাইনবোর্ড লাগালে যা খুশি তাই করা যায়? প্রায় প্রতিদিনের পত্রিকার মফস্বলের পাতায় মসজিদ-মাদ্রাসার অন্দরে অমানবিক ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ড. মুনতাসীর মামুনদের হত্যার অস্ত্রে শান দিতে দিতে ইসলাম দরদীরা এসবের দিকে নজর দিতে সময় পান না। মিথ্যার কালি দিয়ে ইসলামের সুমহান ঐতিহ্যকে ঢেকে ফেলছে জঙ্গী মৌলবাদীরা। ইসলামকে চাপাতি, কিরিচ, কুড়ালের ভয়ঙ্কর ধর্ম হিসেবে খাড়া করছে তারা বিশ্বের সামনে। কোন প-িত, কোন জ্ঞানী ব্যক্তি, কোন মানবদরদী বুদ্ধিজীবী কখনো ইসলামের শত্রু হতে পারেন না। ড. মুনতাসীর মামুনের পিতা আলহাজ মিসবাউদ্দীন খান একজন পরহেজগার মুসলমান। তিনি বিদ্বান, সততার উজ্জ্বল মূর্তি। আসলে ধর্ম নিয়ে মিথ্যাচার করা খুব সহজ। তাই করা হচ্ছে রাজনীতির স্বার্থে। ড. জে. সি দেব ছিলেন একজন দেবতুল্য মানুষ। তিনি আল্লাহর রাসূলের জীবন নিয়ে গবেষণা করতেন। ১৯৭১ সালে এই অজাতশত্রু মনীষীকে পাক জান্তারা ‘হিন্দু’ হওয়ার অপরাধে হত্যা করেছে। এই দার্শনিকের রক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। এই যে রক্ত দিয়ে গড়ে তোলা সেক্যুলারিটি এটা ড. মুনতাসীর মামুনদের হত্যা করেও উপড়ে ফেলা যাবে না। মার্কিন ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ে বলেছেন, ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয় না।’ পৃথিবীর প্রতিটি মহাপুরুষ হিংসা ও হিংস্রতার বিরোধিতা করে গেছেন, মানুষকে ভালবেসেছেন। একজন গবেষক জানাচ্ছেন, ‘কিন্তু মক্কা থেকে রসুল (সা.) ও হযরত আবু বকর (রা.) মদিনায় হিজরতকালে কাফেররা তাদের পশ্চাৎধাবন করেছিল এ কথাটাই আমরা শুধু মনে রাখি। ভুলে যাই যে (প্রায় তিন শ’ মাইলের দীর্ঘ মরুপথে) বিপদসঙ্কুল ওই যাত্রায় তাদের বিশ্বস্ত পথ প্রদর্শকের দায়িত্বও পালন করেন একজন কাফের, আবদুল্লাহ ইবনে ওবায়কীৎ (পরে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।’) (হাসান শফি- ইসলাম ও মৌলবাদ, পৃ: ৩০, শোভা প্রকাশ-২০১৪)। অর্থাৎ মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা সব কালে, সব যুগে, সব দেশেই ছিল। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে মুতাজেলা সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা মুসলমান সমাজে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বপন করেছিলেন। ইসলামের নামধারী কাঠমোল্লাদের হাতে মহান দার্শনিক ইবনে খালদুন, ইমাম আবু হানিফা নিগৃহীত হয়েছেন। এ যুগের কাঠমোল্লা এবং হিংস্রপন্থী, অস্ত্রধারী মৌলবাদীরা ড. মুনতাসীর মামুনের মতো মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার টার্গেট নিয়েছে। সরকারের উচিত ড. মুনতাসীর মামুনের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া। খুনের নেশায় মত্ত যারা তাদের সম্পর্কে শিথিল চিন্তার অবকাশ নেই। লেখক : গবেষক
×