ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনিয়ম দুর্নীতিতে

নৌ সেক্টরে বছরে সাড়ে ৮ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২৩ জুন ২০১৫

নৌ সেক্টরে বছরে সাড়ে ৮ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সার্ভে রিপোর্ট ও সনদ প্রদানের ঘটনায় নৌ সেক্টরে বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার এ সেক্টরে সচেতনতা বৃদ্ধি ও দুর্ঘটনা পরিহার নিয়ে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত নৌ সেক্টরের নানা জঞ্জাল নিয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না থাকায় অরাজক পরিস্থিতি গ্রাস করেছে। ফলে দেশে এবং বিদেশে এ সেক্টরের কর্মকা-ের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে সমালোচিত। নৌ ও সমুদ্রপথে সংঘটিত নানা ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশমালা সরকার সমীপে প্রদান করেছে এর একটিও অদ্যাবধি বাস্তবায়ন হয়নি। আর এ কারণেই সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ রুটে নৌযান চলাচলে নৈরাজ্য ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের সার্বিক দায়িত্ব নৌযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু দেখভাল করা। অথচ কার্যক্রম চলছে ঠিক উল্টো পথে। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের অধীন ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল ও খুলনায় নিবন্ধিত প্রায় ১০ হাজার অভ্যন্তরীণ নৌযানের (যার মধ্যে রয়েছে ১৬শ’ যাত্রীবাহী নৌযান) ফিটনেস প্রদান কাজে রয়েছে মাত্র চার ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার। এ চার ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার এত বিপুলসংখ্যক নৌযানের সনদে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে যত অনিয়মের জন্ম দিচ্ছেন। অফিসে ও ঘরে বসে সমানে এরা কোন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই সার্ভে সনদ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। আর এ কারণেই দেশে বিভিন্ন নৌরুটে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সম্পদ। সূত্র জানায়, ৪০টি সমুদ্রগামী জাহাজ, ২শ’ ফিশিং ট্রলার, ৫ হাজার ফিশিং ও কার্গো বোট, ৩শ’ উপকূলীয় তৈল ও মালবাহী জাহাজ ফিটনেস দেন দুই সার্ভেয়ার। এদের মধ্যে একজন আবার খ-কালীন। অভিযোগ রয়েছে, সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্রের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য অধিদফতরের দুই চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী দৈনিক ১০ থেকে ১৫টি ফিশিং ও কার্গো বোটের ভুয়া সনদ ইস্যুর কাজে লিপ্ত। এ ধরনের ভুয়া সনদ নিয়ে সমুদ্র ও নৌপথে চলাচলকারী অসংখ্য নৌযান মাদকসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালান ও মানবপাচার কাজে জড়িত থেকে দেশের সর্বনাশ করে চলেছে। নৌযান ফিটনেস প্রদানের নেপথ্য কারিগরদের এসব কাহিনী রীতিমতো পিলে চমকানো। এসব নৌযান চালনার সঙ্গে যারা জড়িত তারাও কিভাবে অবাধে সনদ হাতিয়ে নিচ্ছে সে কাহিনী আরও রীতিমতো স্পর্শকাতর। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরে মাত্র চার সার্ভেয়ার নৌযান সার্ভের পাশাপাশি নাবিক ও অফিসারদের পরীক্ষা কার্যক্রমেও নিয়োজিত। গড়ে প্রতিমাসে সমুদ্রগামী জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের ৬শ’ নাবিকের বিভিন্ন গ্রেডের অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার ও ড্রাইভারদের পরীক্ষা কর্মকা- এদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে আসছে। এছাড়া এসব সার্ভেয়াররা অফিসের রুটিন কার্যক্রম, নৌ-দুর্ঘটনার তদন্ত ও বছরে কয়েক দফায় বিদেশ ভ্রমণেও ব্যস্ত থাকেন। সঙ্গতকারণে প্রশ্ন উঠেছে, নৌযানের ফিটনেস ও নাবিকদের সনদ প্রদানে স্বল্পসংখ্যক এ জনবলের পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা। আর এতেই দেশের নৌ নিরাপত্তা বছরের পর বছর প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সূত্র জানায়, এ সেক্টরে মূলত কি ঘটছে আর সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে তা অচিন্তনীয়। এ খাতে অনিয়ম দুর্নীতির কারণে বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। নকল সনদ ও জাল সিডিসির (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) রমরমা অবৈধ বাণিজ্য চলে আসছে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও শিপিং অফিসে। এ দুই দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এন্তার অনিয়মের অভিযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে দফায় দফায় পৌঁছলেও এরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মধ্যে অভিযোগের তদন্ত হয়। সে তদন্তে এরা রহস্যজনকভাবে পার পেয়ে যায়। ফলে অনিয়ম দুর্নীতি ও সরকারী রাজস্ব হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা সমানেই চলছে। জালিয়াতির ঘটনা রোধ না হওয়ায় শিপিং অফিসে সরকার হারাচ্ছে বছরে ৬০ লাখ টাকার রাজস্ব। নৌবাণিজ্য অধিদফতরের পক্ষে মংলামুখী সমুদ্রগামী জাহাজের পরিদর্শন সঠিকভাবে না হওয়ার জের হিসেবে সরকার বছরে রাজস্ব হারায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা। সরকারী শিপিং অফিসের দুর্নীতির কারণে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। নৌ-বাণিজ্য অধিদফতরের ইস্যুকৃত ভুয়া সনদের কারণে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ৪০ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়া সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও নৌ বাণিজ্য অধিদফতরের সার্ভেয়ারদের স্বল্পতা ও যেনতেনভাবে দুই নম্বরী পথে সনদ ইস্যু ও প্রকৃত সুপারভিশন না হওয়ার কারণে সরকার হারাচ্ছে আরও প্রায় চার কোটি টাকার রাজস্ব। সমুদ্র বাণিজ্য অধিদফতরে গত প্রায় বিশ বছর ধরে চার সার্ভেয়ারের মাধ্যমে চলছে নৌযানের ফিটনেস কার্যক্রম। এ বিষয়টি নিয়ে এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের মতে এটি অচিন্তনীয় বিষয়। এসব ব্যাপারে অসংখ্যবার তদন্ত রিপোর্টে সুপারিশ ও বিভিন্নভাবে জানানো হলেও তা থেকে যাচ্ছে অবাস্তবায়িত। ফলে সমুদ্রগামী জাহাজ ও নৌপথের নৌযানগুলোর ফিটনেস ও ক্রুদের সনদ প্রদানে যে নৈরাজ্য চলছে তাতে সচেতনতা ও দুর্ঘটনা পরিহার করা অসম্ভব একটি ব্যাপারে পরিণত হয়ে আছে। প্রসঙ্গত, নৌপথে ভুয়া সনদে চলছে প্রায় ৬ হাজার কার্গো বোট। আর সমুদ্র পথে বিনা সনদে বা ভুয়া সার্ভে রিপোর্ট নিয়ে চলছে ২০ সহস্রাধিক ফিশিং ও কার্গো বোট। নৌ সেক্টরে এ ধরনের নৈরাজ্য বন্ধের উপায় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেসব সুপারিশ ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে এসবই ফাইলবন্দী হয়ে রীতিমতো হিমঘরে চলে গেছে, যা কখনও কাক্সিক্ষত হতে পারে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত রয়েছে।
×