ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ, অনেক নেতা জেলে

বিএনপি বেহাল ॥ জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না ৫ বছর, নির্বাহী কমিটির বৈঠক ৩ বছর

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৩ জুন ২০১৫

বিএনপি বেহাল ॥ জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না ৫ বছর, নির্বাহী কমিটির বৈঠক ৩ বছর

শরীফুল ইসলাম ॥ সাড়ে ৫ বছর ধরে দলের জাতীয় কাউন্সিল করছে না বিএনপি। এমনকি ৩ বছর ধরে জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকও করছে না দলটি। এ কারণে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মানসিকভাবে ভাল না থাকা, বেশ ক’জন প্রভাবশালী নেতা কারাগারে এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে দলের সর্বস্তরে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করায় এ বৈঠক করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রে প্রতি ৬ মাস পর পর জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করার কথা থাকলে গত ৩ বছর ধরে এ বৈঠক হচ্ছে না। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলের ৫ম জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি বিএনপির ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এর পর মাত্র ৩ বার নির্বাহী কমিটির বৈঠক করেছে দলটি। সর্বশেষ বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। এর আগে ২০১০ সালের ৩১ জুলাই প্রথম এবং ২০১১ সালের ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয়বার দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দল পরিচালনার ব্যাপারে হাইকমান্ডের কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে তা নির্বাহী কমিটির বৈঠকে যে কেউ তুলে ধরতে পারেন। আর এর মাধ্যমে পারস্পরিক ভুলবোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দলকে এগিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ড নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করছেন। এ কারণে দলের অনেক নেতার মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রসঙ্গত টানা ৯২ দিনের অবরোধ কর্মসূচী ব্যর্থ এবং ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জনের পর রাজনৈতিকভাবে আবারও নতুন করে সঙ্কটের মুখে পড়েছে বিএনপি। দলের সর্বস্তরে হতাশা ও নতুন করে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এ কারণে সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড। এ অবস্থার উত্তরণে পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। সূত্রমতে, রোজার আগেই দলের সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে জাতীয় কাউন্সিলের পরিবর্তে জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করতে চেয়েছিলেন বিএনপি হাইকমান্ড। এ নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতিও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এখন জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই বলে মনে করছেন তাঁরা। তবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরও ক’জন সিনিয়র নেতা মুক্তি পেলে নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা হবে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের নির্বাহী কমিটিতে যুবদল নেতা আবদুস সালাম আজাদকে সহ-সাংগঠনিক পদে নিয়োগ দেন। নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যুতে এ পদটি খালি হয়। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি তাইফুল ইসলাম টিপুকে সহ-দফতর সম্পাদক পদে নিয়োগ দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের জাতীয় কাউন্সিল কিংবা নির্বাহী কমিটির বৈঠক না ডেকে একক ক্ষমতাবলে তাদের নির্বাহী কমিটিতে স্থান দেয়াকে কেন্দ্র করে দলের ভেতর নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদকে মারধর করে যুবদলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু দলের কোন্দল চাঙ্গা হতে পারে মনে করে আবদুস সালাম আজাদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিএনপি। উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি হাইকমান্ড। এ জন্য সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার জন্য সিনিয়র নেতাদের নিয়ে ৫৬টি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়। গতবছর ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসব কমিটি সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সফর করে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরুর আগেই তৃণমূল পর্যায় থেকে এ নিয়ে তুমুল আপত্তি ওঠে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ পাঠান যে নেতারা দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্দোলন চলাকালে তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যান তাঁরা নিজেদের ভুল স্বীকার না করে তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠনের অধিকার রাখেন না। কারণ তৃণমূল নেতাকর্মীরা র‌্যাব-পুলিশের মারমুখী অবস্থানকে উপেক্ষা করেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে লাগাতার আন্দোলন অব্যাহত রাখলেও তাদের খবর কেন্দ্র থেকে কেউ নেয়ার চেষ্টা করেননি। তাই নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকলে জেলা নেতারা আবারও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর চড়াও হতে পারেন এমন আশঙ্কাও সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আছে বলে জানা গেছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটিসহ সারাদেশের সকল ইউনিট কমিটিই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলো পুনর্গঠনের জন্য বার বার উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সর্বস্তরে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণার আগে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের কথা বলা হলেও এখনও এ ধরনের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জানা যায়, সাংগঠনিক দুরবস্থার কারণে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা এখন আর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। বরং কেন্দ্রীয় নেতাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে তাঁরা সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে নিজ নিজ এলাকায় ঝামেলামুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। এতে সারাদেশে বিএনপির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর দলের স্থবিরতা কাটিয়ে তুলতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি দলের জাতীয় কাউন্সিল করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এখন জাতীয় কাউন্সিলের জন্য উপযোগী নয় মনে করে তিনি চেয়েছিলেন আপাতত নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করতে। কিন্তু পরবর্তীতে সে অবস্থান থেকেও আস্তে আস্তে সরে আসেন তিনি। প্রসঙ্গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর বিএনপির অবস্থা বিপর্যস্ত হয়। তাই তখন দলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তৃণমূল পর্যায় থেকে দলের কমিটি পুনর্গঠনের যে উদ্যোগ তিনি শুরু করেন তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। কারণ সারাদেশে জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন স্তরের তৃণমূল কমিটি গঠন নিয়ে নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে ঘর গুছানোর কাজ কাজ শুরু করা হয় সে উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরে ২০০৯ সালের জুন মাসে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেন দলের হাইকমান্ড। কিন্তু এই আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলে কাউন্সিলরদের ভোটে প্রথমে উপজেলা কমিটি ও পরে অনুরূপভাবে জেলা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এই পদ্ধতিতে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে সকল কমিটি গঠনের শেষ সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু এতে ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জেলা-উপজেলায় কমিটি ছাড়াই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করা হয় ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। এ কাউন্সিলের আগে ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ২০টি জেলার কমিটি গঠিত হয়। এ পরিস্থিতিতে বাকি ৫৫টি জেলা থেকে জাতীয় কাউন্সিলের জন্য কাউন্সিলর ঠিক করে দেয়া হয় কেন্দ্র থেকেই। তবে আবার যেন একই কাজ না করতে হয় সে জন্যই এবার নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে কেন্দ্রে শূন্যপদগুলো পূরণ করে পরে জেলা-উপজেলা কমিটি করার প্রস্তুতি নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ অবস্থান থেকে ইতোমধ্যেই সরে এসেছেন দলীয় হাইকমান্ড। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলের পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী গঠন করে বিএনপি। কিন্তু এ কমিটির অধিকাংশ নেতা নিষ্ক্রিয় এবং কিছু নেতা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকায় সাংগঠনিক দুর্বলতা থেকেই যায়। তবে চারদলীয় জোটকে প্রথমে ১৮ দলীয় জোট ও পরে ২০ দলীয় জোট করে এর মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচী এগিয়ে নেয় বিএনপি। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেতাকর্মীদের রাজপথে বিপদের মুখে রেখে কেন্দ্রীয় নেতারা দলে দলে পালিয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এই ফাঁকে আওয়ামী লীগ তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সরকারও গঠন করে ফেলে। আর সে সরকারের প্রতি বিশ্বেও বিভিন্ন দেশ একের পর এক সমর্থনও দিয়ে ফেলে। তাই এ পরিস্থিতিতে সহসা বিএনপির আর ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ না থাকায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আর এ কারণেই সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে তুলতে দলের হাইকমান্ডকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩৮৬ সদস্যের বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে এখন ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে ২টি পদ শূন্য। ১৭টি ভাইসচেয়ারম্যান পদের মধ্যে ২টি পদ শূন্য। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হওয়ার পর থেকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদটিও শূন্য। এ ছাড়া বিভিন্ন সম্পাদকীয় ও সদস্য পদে আরও বেশ কিছু পদ শূন্য রয়েছে। আর এ পদগুলো পূরণ করার জন্যই নির্বাহী কমিটির বৈঠক করতে চেয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আপাতত এ বৈঠক না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, গঠনতন্ত্রে ৬ মাস পর পর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করার নিয়ম থাকলেও পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় তা করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা কারাগারে এবং দলের কোন স্তরের নেতাকর্মী স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচীও পালন করতে পারছেন না। তাই যখন পরিবেশ অনুকূলে আসবে তখই বিএনপির নির্বাহী কমিটির বৈঠক হবে।
×