ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমুদ্র থেকে উদ্ধার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী হিসেবে চালাতে দুরভিসন্ধি আঁটছে ;###;পতাকা বৈঠকে বসতে সম্মতি বিজিপির;###;দ্রুততম সময়ে বিজিবি নায়েককে ফিরিয়ে আনা হবে ॥ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নতুন ফন্দি ॥ এটা কি ব্ল্যাকমেল!

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৩ জুন ২০১৫

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নতুন ফন্দি ॥ এটা কি ব্ল্যাকমেল!

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ অপহরণের ৬ দিনেও মিয়ানমারের বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) ফেরত দেয়নি অপহৃত বিজিবি নায়েক আবদুর রাজ্জাককে। বিজিবি’র পক্ষে বিজিপি’র সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার পর সর্বশেষ দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিজিপি সোমবার পতাকা বৈঠকে সম্মতি প্রদান করেছে। আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নায়েক আবদুর রাজ্জাককে বিজিপি আটক করে রাখার ঘটনায় সরকার উদ্বিগ্ন। সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, পতাকা বৈঠকের এখনও সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি। তবে আশা করা হচ্ছে, দ্রুততম সময়ে এ বৈঠক শেষে রাজ্জাককে ফেরত আনা হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে আইনের শাসন নেই। চলছে সামরিক শাসন। তবে আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাই না। কোন রকম গুলিবিনিময় ছাড়াই সব সমস্যার সমাধান হবে কূটনৈতিক তৎপরতায়। শীঘ্রই এ তৎপরতায় রাজ্জাকের বিষয়টি শেষ হবে। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের জিম্মায় রাজ্জাক যে রয়েছেন তা মিয়ানমার নিশ্চিত করেছে। এদিকে, প্রশ্ন উঠেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিজিবি’র নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে কিনা। বিজিবির একটি সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, রাজ্জাক ইস্যুতে মিয়ানমার উপকূলে উদ্ধারকৃত অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশী হিসেবে ফেরত নিতে বাধ্য করার জন্য ফন্দি এঁটেছে মিয়ানমার। সমুদ্র পথে সাম্প্রতিক মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী হতে গিয়ে সে দেশের উপকূলে আটকাপড়া ৯৩৫ জনকে দু’দফায় উদ্ধার করে মিয়ানমারের নৌবাহিনী। যাচাই বাছাই শেষে ইতোমধ্যে দু’দফায় ১৮৭ জনকে বাংলাদেশ ফেরত এনেছে। অবশিষ্ট ৭৪৮ জনের মধ্যে মিয়ানমার কর্র্তৃপক্ষ ৫ শতাধিক বাংলাদেশী রয়েছে বলে দাবি করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ফেরত না আনতে গৃহীত সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারে উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশ সেদেশের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমান। যাদের মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নির্যাতন নিপীড়নে দেশান্তরী হতে বাধ্য করছে। ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত প্রায় সকলকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় মিয়ানমার। এ অবস্থায় গত বুধবার বিজিবি নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করে নেয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিত বলে বিজিবির বিভিন্ন সূত্রের ধারণা। তারা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ উদ্ধারকৃতদের মধ্যে যে ৫ শতাধিককে বাংলাদেশী হিসেবে ফেরত পাঠাতে চায় তাদের বাংলাদেশ গ্রহণ না করলে বিজিবি নায়েক আবদুর রাজ্জাককেও ফেরত না দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনে আইনী পন্থা অবলম্বন করতে পারে। আবদুর রাজ্জাককে অপহরণ করে নেয়ার পর বিজিবির পক্ষ থেকে যতবারই এ ব্যাপারে কথা বলতে চাওয়া হয়েছে ততবারই বিজিপি জানিয়েছে ইতোপূর্বে সে দেশের উপকূলে উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের নিয়ে ব্যস্ত। উদ্ধারকৃত সকলের ব্যাপারে সুরাহা হলেই নায়েক রাজ্জাক ইস্যুতে কথা বলবে। টেকনাফে ৪৪ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ সোমবার জানিয়েছেন, বিজিপির পক্ষ থেকে কখনও বলা হচ্ছে না তারা রাজ্জাককে ফেরত দেবে না। তবে তাদের কার্যক্রম দেখে ধারণা করা যাচ্ছে যে, আগে তারা সে দেশে উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের বিষয়ে সুরাহা করতে চায়। রাজ্জাককে ফেরত দেয়ার আগে উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের মধ্যে তারা যাদের বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার যাতে তাদের গ্রহণ করে নেয়। অর্থাৎ রাজ্জাককে তারা এখন অভিবাসী ফেরত ইস্যুতে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এদিকে, অনুসন্ধানে আরও অভিযোগ উঠে এসেছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে চোরাপথে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য এবং চোরাচালানের নানা পণ্যের অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি (সাবেক নাসাকা)। সে দেশের চোরাচালানি চক্রের সঙ্গে বিজিপির পদস্থ কর্তাসহ সাধারণ সদস্যরা জড়িয়ে আছে এই চোরাচালান ও পাচার বাণিজ্যে। আর এ কারণেই সে দেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসব চোরাচালানের পণ্য ও মাদকদ্রব্য অবাদে প্রবেশের রুট হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করায় বিজিবি সদস্যরা দুদেশের ২৭১ বর্গ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা জুড়ে কঠোর নজরদারি আরোপ করে রেখেছে। কিন্তু এরপরও বিজিপির সহায়তায় চোরাচালানি চক্র বিভিন্নভাবে নানা ফাঁকফোকরে এসব অবৈধ কর্মকা-ে লিপ্ত থেকে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে চলেছে। স্থল সীমান্ত ছাড়া নাফ নদীর ৫১ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে দুদেশের নদী সীমান্ত। এ নদীতে প্রতিদিন মিয়ানমারের বিজিপি ও বাংলাদেশের বিজিবি সদস্যরা টহল দিয়ে থাকে। বিজিপির টহলে চোরাচালানিরা সহযোগিতা পায় আর বিজিবির টহল চোরাচালানিদের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। দুদেশের স্থল ও নৌ-সীমান্তে এ পর্যন্ত বহুবার গোলাগুলি, সংঘর্ষ ছাড়াও অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। প্রায়শ বিজিপি সদস্যরা নাফ নদীতে মাছ শিকাররত মাঝিমাল্লাদের ধরে সে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। নানাভাবে নির্যাতন চালায়। পরে মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনা এক ধরনের নিত্যনৈমিত্তিক। বছরের পর বছর সামরিক শাসনের কবলে থেকে সেখানকার সেনা ও স্থল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বহু শীর্ষ ও সাধারণ সদস্য মানবপাচার ইয়াবাসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালান এমনকি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে থাকার অভিযোগ রয়েছে। মানবপাচারের সাম্প্রতিক ঘটনায় থাইল্যান্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়ে ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। মিয়ানমারেও এ জাতীয় বহু সদস্য রয়েছেন যারা এ জাতীয় কর্মকা-ে লিপ্ত। গত বুধবার মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা নাফ নদীতে বিজিবির টহল সদস্যদের উপর গুলি চালালে বিপ্লব নামের একজন সদস্য গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া নাফ নদীর বাংলাদেশী জলসীমার অভ্যন্তরে এসে বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ইঞ্জিন বোটসহ অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণের পর এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী নায়েক রাজ্জাকের উপর বিজিপি সদস্যরা নির্যাতন চালিয়েছে। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তার ছবি প্রচার করেছে, যা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, জেনেভা কনভেনশনেরও লঙ্ঘন বলে বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে। গত ৬ দিনেও বিজিবি নায়েক রাজ্জাককে তারা ফেরত দেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। উল্টো সে দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশকারী হিসেবে রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তাকে ফাঁসানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সোমবার মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা পতাকা বৈঠকে বসছে এবং অপহৃত আবদুর রাজ্জাককে ফেরত দেবে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ঐ দিন মূলত যে স্থানে অর্থাৎ দমদমিয়া সীমান্ত এলাকার লাইল্লার চর এলাকার পরে লালদ্বীপ নামক যে ভূখ- রয়েছে এর অধিকাংশ মিয়ানমারের। ওই দিন ভোর ৫টার দিকে বিজিপি সদস্যদের একটি দল মূলত ইয়াবার একটি চালান এ দেশে প্রেরণের প্রস্তুতিতে ছিল। এ সময় বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি টহল দল ইঞ্জিন বোটযোগে সে এলাকায় গিয়ে পৌঁছে। উভয় সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে কথাবার্তার একপর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। বিজিপির পক্ষ থেকে গুলি চালালে বিজিবিও আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। এ সময় বিজিবির টহল যানে মাঝিসহ ছিলেন ৩ সদস্য। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিজিবি সদস্য বিপ্লব গুলিবিদ্ধ হয়। তিনিসহ ২জন নদীতে পড়ে যান। এ সময় ইঞ্জিনবোটে ছিলেন নায়েক আবদুর রাজ্জাক ও নৌকার মাঝি। বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাগানো ইঞ্জিন বোট, এর মাঝি এবং নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মাঝিকে ছেড়ে দেয়া হলেও রাজ্জাককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ইঞ্জিন বোটটি আটকে রাখা হয়েছে। এ ঘটনার পর ইতোমধ্যে বিজিবির পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিজিপির সঙ্গে দফায় দফায় মুঠো ফোনে আলোচনা চলেছে। আজ-কাল, পরশু রাজ্জাককে ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেও তারা এখন অনেকটা পিছু হটে রয়েছে বলে প্রতীয়মান। যদিও বিজিবি বার বার বলেছে, নায়েক রাজ্জাককে সহসা ছেড়ে দিতে তারা বাধ্য হবে। আর রাজ্জাকের উপর ইতোমধ্যে নির্যাতন চালিয়ে, দু’হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে যে ছবি প্রচার করা হয়েছে এর সবই মৌলিক অধিকার ও জেনেভা কনভেনশন পরিপন্থী। নায়েক আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বিজিপির পক্ষ থেকে সে দেশে অনুপ্রবেশের দায়ে অভিযোগ এনে মামলা রুজুর খবরের ব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া না গেলেও বিজিপি সদস্যরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে নায়েক রাজ্জাককে দাবার গুটি বানাতে চাইছে। কারণ, গত বুধবার বিজিপি সদস্যরাই নাফ নদীতে বাংলাদেশী সীমানার অভ্যন্তরে ঢুকে গুলি চালায় এবং নায়েক রাজ্জাককে বাংলাদেশী ফ্লাগধারী নৌকাসহ অপহরণ করে নিয়ে যায়। প্রসঙ্গত, বন্ধুপ্রতীম দেশ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি এবং বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদল বিজিবি প্রতিনিয়ত সকাল-সন্ধ্যা টহলে থাকে নাফ নদীর সেপার ও এপারে। বিভিন্ন সময় নাফনদীর মধ্যবর্তী স্থানেও দু’দেশের সীমান্তরক্ষীরা স্ব-স্ব জলসীমার অভ্যন্তরে টহলে থাকে। এ পর্যন্ত রেকর্ড অনুযায়ী মিয়ানমারের বিজিবি সদস্যরা যত অন্যায় ও অবৈধ হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটিয়েছে সে তুলনায় বিজিবি সদস্যদের এ ধরনের কোন রেকর্ড নেই। তবে গত কয়েকমাস আগে নাফ নদীর সীমান্তে বিজিপির পক্ষ থেকে গুলিবর্ষণের ঘটনার বিপরীতে বিজিবির পক্ষ থেকে ব্রাশফায়ার করা হলে সে দেশের কর্মকর্তাসহ চার সেনা সদস্য প্রাণ হারায়। এ ঘটনা বিজিপি যখন প্রকাশ করেনি, বিজিবিও এ নিয়ে কোন বক্তব্য দেয়নি। কিন্তু ঘটনাটি নিয়ে বিজিপি ছিল ক্ষুব্ধ। এছাড়া স্থল ও নাফ নদীর সীমান্ত দিয়ে সাম্প্রতিক বিজিপির সহযোগিতায় ইয়াবাসহ চোরাচালানের ঘটনায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনায় বিজিপির আঁতে ঘা লেগেছে বলেই সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন সূত্রে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। আরও জানা গেছে, নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অধীনে মংডু টাউনশিপ ও বুচিদং, রাচিদংসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত হয়েছে প্রায় ২৭টি ইয়াবা উৎপাদনকারী কারখানা। এসব কারখানা নিয়ন্ত্রণে সে দেশের সেনা ও সীমান্তরক্ষী দলের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিজিপির পক্ষে বহু আগেই সুনির্দিষ্টভাবে ১৩টি কারখানার স্থান উল্লেখ করে তা বন্ধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও কার্যকর রয়েছে। আর চালানে চালানে ইয়াবা আসছে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে। বিপুল অঙ্কের অর্থে এ অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে কক্সবাজার অঞ্চলের প্রভাবশালী অনেকেই জড়িত। কিন্তু হাতেনাতে ধরা না পড়ার কারণে গডফাদাররা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, স্থল ও নদী সীমান্ত পথে বিজিপির মনোভাব বরাবরই একগুয়েমি হিসেবে প্রকাশ পায় বিজিবির কাছে। এরপরও সীমান্তে উত্তেজনা না বাড়াতে বিজিবির পক্ষ থেকে সর্বদা সতর্কাবস্থানে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও বিজিপি সদস্যরা প্রায়শ বিভিন্ন কর্মকা-ে বিজিবিকে উত্তেজনায় নিয়ে যেতে চেষ্টা চালায় বলে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য রয়েছে। নাফ নদীতে মৎস্য শিকাররত বাংলাদেশী জেলেদের কোন কারণ ছাড়াই বিজিপি সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। মারধর করে তাদের সঙ্গে থাকা যা পায় তা লুট করে নেয় এবং পরে মুক্তিপণ আদায় করে এদের ছেড়ে দেয়। এ ধরনের ঘটনা হর হামেশাই ঘটে চলেছে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাগর পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার যে ঢল নামে এ কাজে বিজিপির সম্পৃক্ততা যে ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ যেসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে দেশান্তরি হয়েছে এবং যারা উদ্ধার হয়ে সে দেশে রয়েছে তাদের বক্তব্যেই সীমান্ত অতিক্রমের সময় বিজিপি সদস্যদের অর্থগ্রহণের বক্তব্য মিলেছে। এদিকে, বিজিবি নায়েক আবদুর রাজ্জাককে অপহরণ করে নেয়ার পর তার মুক্তির বিষয়টি এখনও অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে রয়েছে। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দেশটির জলসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে বলে ওপারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নায়েক রাজ্জাককে দ্রুত ফিরিয়ে দিতে আবারও মিয়ানমারকে গত রবিবার অনুরোধ বার্তা পাঠায় বিজিবি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, বিষয়টি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী দলের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে উভয় সীমান্তে অহেতুক গুলিবর্ষণ না করার যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের ৩ দিনের মাথায় বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে বিজিপি। গত বুধবার ভোরে নাফনদীর লালদিয়া নামক স্থানে বিজিপি বাংলাদেশে জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে বিনা উস্কানিতে গুলি ছোড়ে নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করে নিয়ে যায় বিজিবি সদস্যদের বহনকারী দেশীয় ইঞ্জিন বোটটিসহ। যাতে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো ছিল। অথচ গত ১৪ জুন কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিজিপির মধ্যকার সীমান্ত সমন্বয় সভায় দু’দেশের সীমান্তে শৃঙ্খলা রক্ষায় উভয় দেশ সম্মত হয়। সভায় সীমান্তবর্তী এলাকায় গুলিবর্ষণ না করারও আশ্বাস দেয় বিজিপি। কিন্তু বৈঠকের ৭২ ঘণ্টার মাথায় তার উল্টোটা দেখাল বিজিপি। ঐদিন যা ঘটেছিল ॥ নাফ নদীতে মাছ শিকাররত জেলেরা, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বুধবার ভোর ৫টার দিকে টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের দমদমিয়া বিওপি’র বিজিবি জওয়ানরা ট্রলারযোগে নাফ নদীতে টহলে যান। এ সময় নাফ নদীর লালদিয়া নামক দ্বীপের কাছাকাছি একটি জেলে নৌকা তল্লাশি চালানোর সময় মিয়ানমারের রইক্যাদং ক্যাম্পের (বর্ডার গার্ড পুলিশ) বিজিপি সদস্যরা বিজিবি টহলদলের কাছাকাছি এসে টহলদলের উপর বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। বিজিবিও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় টহল নৌকায় থাকা বিপ্লব কুমার নামে বিজিবি জওয়ান গুলিবিদ্ধ হয়। টহলে থাকা রাজ্জাক নামে অপর এক জওয়ানকে বিজিপি জোর পূর্বক বাংলাদেশী ইঞ্জিন বোটসহ অপহরণ করে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। সীমান্তের ওপারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নাফনদীর লালদিয়া পয়েন্ট হয়ে চোরাচালানিরা প্রায় সময় ইয়াবা, মাদকসহ আমাদানি নিষিদ্ধ পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। বিনিময়ে বিজিপি সদস্যরা পেয়ে থাকে মোটা অঙ্কের অর্থ। ইতোপূর্বে বিজিবি সদস্যরা ঐ লালদিয়া স্থানে তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবাসহ কয়েক লাখ টাকার চোরাচালানি পণ্য উদ্ধার করেছে। তদ্রƒপ ঐদিনও বিজিবি একই কায়দায় একটি নৌকা তল্লাশি করাকালে মিয়ানমারের বিজিপি এসে গুলিবর্ষণ করে। অপহরণ করে নিয়ে যায় নায়েক রাজ্জাককে। বিজিবির সেক্টর কমান্ডার দফতর সূত্র জানায়, অপহৃত নায়েক আব্দুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে ও অপহৃত বিজিবি সদস্যকে শীঘ্রই ফেরত দেয়ার জন্য চিঠি পাঠানো ছাড়াও মুঠোফোনেও বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। সর্বশেষ বিজিপি কর্তৃপক্ষ পতাকা বৈঠকে বসার জন্য সম্মত হলেও পতাকা বৈঠকের দিন তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। ওপারের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিজিবি সদস্যকে ফেরত দিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ পতাকা বৈঠকে বসার আশ্বাস দিয়ে কৌশল অবলম্বন করেছে মাত্র। তারা নায়েক রাজ্জাককে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করেছে মর্মে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এ সংক্রান্তে বিজিবির কাছে পত্র পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিজিবি আশা করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অনাহুত উত্তেজনাকর পরিস্থিতি জন্ম দেবে না। তারা সসম্মানে নায়েক রাজ্জাককে ফেরত পাঠাবে। তবে পতাকা বৈঠকে সে দেশের উদ্ধারকৃত অভিবাসীদের বাংলাদেশী হিসেবে ফেরত নেয়ার বিষয়টি উঠে আসতে পারে। প্রসঙ্গত, বিজিপি সদস্যরা নাফ নদী ও স্থল সীমান্ত এলাকায় মাঝেমধ্যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে থাকে। এটা অনেকটা বিজিপির স্বভাবজাত। অথচ, এর নেপথ্যে রয়েছে মাদক পাচার ও চোরাচালানের ঘটনা। গত ২০১৪ সালের ২৮মে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিপি ৫২নং সীমান্ত পিলারের পার্শ্বে টহলদলের উপর বিনা উস্কানিতে গুলি করেছিল। এতে নাইক্ষ্যংছড়ির পাইনছড়ি বিওপির নায়েক মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে মারা যান। পরে ওই বিজিবি সদস্যের লাশ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা সেদেশে নিয়ে যায়। বিজিবি কর্তৃপক্ষের কড়া প্রতিবাদের মুখে ৩দিন পর নিহত নায়েক মিজানের লাশ ফেরত দিতে বাধ্য হয় মিয়ানমারের বিজিপি কর্তৃপক্ষ। বারবার সীমান্তে এভাবে বিনা উস্কানিতে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যদের গুলিবর্ষণ ঘটনা কাক্সিক্ষত নয় বলে জানিয়েছে বিজিবি সূত্র। নায়েক রাজ্জাক বাংলাদেশী ইঞ্জিনবোটসহ অপহৃত হওয়ার পর সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা না থাকলেও স্থানীয় জেলেরা নাফ নদীতে মাছ শিকারে যেতে ভয় পাচ্ছে। সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অপহৃত বিজিবির নায়েক রাজ্জাককে মিয়ানমারের ১২নং সেক্টরে বিজিপির ক্যাম্পে রাখা রয়েছে। তার উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সে দেশে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগ আনার ষড়যন্ত্র করছে মিয়ানমারের বিজিপি। ইতোপূর্বেও বিজিপি নাফনদীতে বিজিবি ও জেলেদের উপর গুলি করে আহত এবং জেলেদের অপহরণ করে সেদেশে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়ার একাধিক ঘটনার নজির রয়েছে। গত এপ্রিল মাসে সীমান্তে ঘুমধুমের বাসিন্দা পুতিক্যা নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে গুরুতর আহত করেছিল বিজিপি। এরপর মার্চ মাসেও লালদিয়া নামক স্থানে বিজিবি সদস্যরা একটি নৌকা তল্লাশি করার সময় তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে বিজিপি সদস্যরা। এর আগে ২০১২ সালে বাংলাদেশ জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে বিজিপি সদস্যরা তুমব্রু এলাকার মৌলভী আবদুস সালামের পুত্র ফরিদুল হক, নুরুল ইসলামের পুত্র বক্তার আহমদ ও ইমান শরীফের পুত্র আবুল কাশেমকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করায় অপহৃতদের স্বজনদের পক্ষে তাদের ছাড়িয়ে সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিজিপি ঐ তিন যুবককে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে তাদের স্বজনরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে প্রায় তিন বছর জেল খাটার পর এদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদল মিয়ানমারের বিজিপির উপর কোন সময় হামলা না করলেও মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রায় সময় বিজিবি ও বাংলাদেশী লোকজনের উপর হামলা চালিয়ে থাকে। মিয়ানমার চ্যালেঞ্জ করে ইতোপূর্বে একবার বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সঙ্গে যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মাত্র তিন দিনের মাথায় তৎকালীন নাসাকা বাহিনী পিছুটান দেয়। ফলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
×