ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আরল সাগর এখন মরুভূমি

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৩ জুন ২০১৫

আরল সাগর এখন মরুভূমি

আরল সাগরের এক বিরাট অংশ শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। মধ্য এশিয়ার কাজাকিস্তানের দক্ষিণাংশ ও উজবেকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২৬ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই স্বাদু পানির হ্রদটি ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। স্রেফ বিশালত্বের জন্যই একে বলা হতো সাগর। কিন্তু মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শিতার শিকার হয়ে এই সুবিশাল হ্রদের পূর্ব অববাহিকা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এই অঞ্চল এখন আরলকুম মরুভূমি নামে পরিচিত। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধূধূ বালুরাশি। মাঝে মাঝে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুল্মের ঝোপঝাড়। কখনওবা চোখে পড়বে মরুর বুকে পরিত্যক্ত মরচে ধরা জাহাজ বা ট্রলার। হাজার হাজার বছর ধরে আরল সাগর আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নদী দুটির দ্বারা সিঞ্চিত হয়ে এসেছিল। হ্রদের পানি বাইরে যাওয়ার পথ ছিল না। দুই নদীর পানি এই হ্রদে এসে পড়ত এবং প্রাকৃতিক বাষ্পীভবনে বাড়তি জলরাশি উবে যেত। ফলে পানির স্তরের একটা স্বাভাবিক ভারসাম্য সর্বদাই থাকত। আলেকজান্ডার চতুর্থ শতকে এই ভূখ- যখন দখল করেন, তারও অনেক আগে থেকে নদী দুটো মধ্য এশিয়ার প্রাণপ্রবাহ হিসেবে কাজ করে আসছিল। আরল সাগর ও এর অববাহিকা ঘেঁষে প্রাচীন জনগোষ্ঠী যেমন তাজিক, উজবেক, কাজাক ও অন্যান্য জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে। এরা কৃষিজীবী, জেলে, পশুপালক, কারিগর, বণিক ও অন্যান্য পেশায় সমৃদ্ধি লাভ করে। কিন্তু আরল সাগরের অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯২০-এর দশকের প্রথম ভাগে যখন স্টালিন সোভিয়েতভুক্ত মধ্য এশিয়ার এই প্রজাতন্ত্রগুলোতে ব্যাপক পরিসরে তুলা চাষের উদ্যোগ নেন। তুলা চাষের জন্য প্রচুর পানি দরকার। এ অঞ্চলের উষ্ণ পরিবেশ তুলা চাষের অনুকূল ছিল না। তখন সোভিয়েতওয়ালারা বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম উচ্চাভিলাষী প্রকৌশল প্রকল্প হাতে নেয়। শ্রমনির্ভর হাজার হাজার মাইল সেচ খাল খনন করে আমুদরিয়া ও সিরদরিয়ার পানি আশপাশের শুরুভূমিগুলোতে নিয়ে তুলা চাষ করা হতে থাকে। ষাটের দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা মোটামুটি টেকসই ছিল। কিন্তু এ দশকে আরও সেচ খাল খনন করে পানি টেনে নেয়ার ফলেই বিপর্যয় নেমে আসতে শুরু করে। ব্যবস্থাটি আর টেকসই থাকতে পারল না। তারা জানত তারা কী করছে। কিন্তু এর পরিবেশ-প্রতিবেশগত ব্যাপক পরিণতি বিশেষ করে আরল সাগরের পানি যে দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা বুঝে উঠতে পারেনি। ১৯৮৭ সাল নাগাদ আরল সাগরের পানির স্তর ভয়াবহ আকারে হ্রাস পেয়ে দুটি স্বতন্ত্র জলধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটা হলো উত্তর আরল সাগর, যা কাজাকিস্তানে অবস্থিত। অন্যটি তার চেয়ে বৃহত্তর দক্ষিণ আরল সাগর, যা কারাকালপাকস্তানের মধ্যে অবস্থিত। ২০০২ সালে দক্ষিণের এই অংশটির পানি এত কমে যায় যে, সেটাও আবার পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই সাগরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গত বছরের জুলাইয়ে এই পূর্বের সাগরটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। এই নিরানন্দ চিত্রের একমাত্র উজ্জ্বল দিকটি হলো সম্প্রতি উত্তর আরল সাগরটিকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজাকরা ২০০৫ সালে এই উত্তর সাগরের দক্ষিণ তীরে ৮ মাইল দীর্ঘ এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে সিরদরিয়ার জলধারায় সিঞ্চিত একটা সম্পূর্ণ আলাদা হ্রদ সৃষ্টি করেছে। বাঁধটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে উত্তরের আরল সাগর এবং এর মৎস্যসম্পদ প্রত্যাশার তুলনায় অনেক দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। তবে এই বাঁধের কারণে দক্ষিণের আরল সাগর তার একটি গুরুত্বপূর্ণ পানির অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে এটি এখন তার অনিবার্য মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে। ব্যাপক সেচকাজ ও খরার কারণে দক্ষিণ আরল সাগরের পূর্বাংশের পানির স্তর কমতে কমতে ২০১৪ সালে নাগাদ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। আরল সাগরের এই ট্র্যাজেডির জন্য তৎকালীন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে বহুলাংশে দায়ী করা চলে। সেচখাল খননের পরিকল্পনা নেয়ার সময় তারা ভালমতোই জানত, এতে করে তারা আরল সাগরের অপমৃত্যু ডেকে আনছে। তাদের কাছে এই হ্রদটির আলাদা কোন গুরুত্ব ছিল না। এটাকে তারা প্রকৃতির ভুলবশত সৃষ্টি বলে ভাবত। তাদের কাছে মাছের চেয়ে মূল্যবান ছিল তুলা। সেই তুলা উৎপাদন আজও চলছে। প্রতিবছরের শরতে উজবেকিস্তানের প্রায় ৩ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ নারী-পুরুষকে তথাকথিত স্বেচ্ছাশ্রমে তুলা আহরণ করতে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে থাকে সরকারী কর্মচারী, স্কুলের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি সিনিয়র নাগরিকরাও। বাসে করে তাদের তুলাক্ষেতে নেয়া হয় দৈনিক কোটা আহরণের জন্য। এ সময়টা সরকারের কাজকর্ম কার্যত বন্ধ থাকে। বিশ্বের যে গুটিকয়েক দেশে সরকার বাধ্যতামূলক শ্রম সংগঠিত ও বলবৎ করে, উজবেকিস্তান তার একটি। আরল সাগরের উজবেকিস্তানের অংশটির আজ অতি বেহাল অবস্থা। বেশিরভাগ অংশ শুকিয়ে মরুভূমির রূপ নিয়েছে। ৪০ বছর আগে সেখানে ৩০ মিটার বা প্রায় এক শ’ ফুটে গভীর পানি ছিল, সেখানে এখন ধূধূ বালুরাশি। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। মরুর বুকে লবণের ঘূর্ণিঝড় উঠছে। এমন পরিণতি সোভিয়েতওয়ালারা ধারণা করতে পারেনি। তারা মনে করেছিল, সাগর শুকিয়ে গেলে পৃষ্ঠদেশের ওপর সোডিয়াম ক্লোরাইডের কঠিন স্তর তৈরি হবে এবং কোন লবণঝড় হবে না। তাদের ধারণা ভুল ছিল। শুকিয়ে যাওয়া আরল সাগরের বুকে আজ সোডিয়াম ক্লোরাইডের উপস্থিতি বিষাক্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। এর ধুলারাশিতে মিশে আছে ডিডিটি, হেক্সাক্লোরোসাইক্লোহেক্সেন, টোক্সাফেন, ফোসালোনের মতো কীটনাশক পদার্থ। এগুলো সবই কার্সিওজেন হিসেবে পরিচিত, যা থেকে ক্যান্সার হতে পারে। এই রাসায়নিকগুলো খাদ্যচক্রের প্রতিটি স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। কারাকালপাকস্তানে খাদ্যনালীতে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার আজ বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। যক্ষ্মা এখানে এক বড় সমস্যা। তা ছাড়া শ্বাসনালীর রোগ, ক্যান্সার, জন্মগত খুঁত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৈকল্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আরও একটি ভয়াবহ তথ্য হলোÑ একদা এই আরল সাগরে সোভিয়েতের জীবাণু অস্ত্র পরীক্ষার গোপন স্থাপনা ছিল। সেটি ছিল ভোজরোজদেনিয়া দ্বীপে। সমুদ্রই যেখানে শুকিয়ে গেছে, সেখানে এই দ্বীপটিরও আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তবে ওই গোপন স্থাপনাটি ছিল সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর জীবাণুযুদ্ধ গ্রুপের প্রধান পরীক্ষাক্ষেত্র। হাজার হাজার জীবজন্তুকে জাহাজে করে এই দ্বীপে আনা হতো এবং সেগুলোর ওপর এনথ্রাক্স, গুটিবসন্ত, প্লেগ, ব্রুসেলোসিস ও অন্যান্য জীবাণু এজেন্ট পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হতো। আজও এই অঞ্চলের আশপাশের এলাকায় মাঝেমধ্যে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে দেখা যায়। আরল সাগর যেখানে শুকিয়ে গেছে, সেখানে মাঝেমধ্যে চোখে পড়বে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের রিগ। সমুদ্রের তলদেশ জেগে ওঠার পর থেকেই রিগ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিবছরই কয়েকটি করে রিগ বসছে। উজবেকিস্তানের যে অংশটুকুতে আরল সাগর এখনও কিছুটা টিকে আছে, সেখানে জলরাশি দেখা যায় বটে। তবে সেই জলরাশির স্রোত নেই, জোয়ার নেই। বোঝাই যায় সাগর ক্রমশ সরে যাচ্ছে। এই জলরাশিতে এক ধরনের চিংড়ি ছাড়া জীবন্ত প্রাণী বলতে আর কিছু নেই। আরল সাগর যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, এর জলরাশি ছিল ঈষৎ লোনা। লবণাক্ততার মাত্রা ছিল প্রতি লিটারে ১০ গ্রাম। অন্যদিকে বিশ্বের মহাসমুদ্রগুলোর লবণাক্ততার মাত্রা প্রতি লিটারে ৩৩ থেকে ৩৭ গ্রাম। আজ এই আরল সাগরের লবণাক্ততার মাত্রা প্রতি লিটারে ১১০ গ্রামের বেশি। যার ফলে সব প্রজাতির মাছের জন্য এই পানি হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। অতি লবণাক্ততার কারণে আরল সাগরের পানির ঘনত্ব এত বেশি যে, ওই পানিতে সহজেই ভেসে থাকা যায়। এটা অবশ্য উজবেকিস্তানের অংশের আরল সাগরের অবস্থা অথচ ২৬ হাজার বর্গমাইলের আরল সাগরের পানি ছিল স্বাদু পানি। নানা প্রজাতির মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এটা। এর মৎস্যসম্পদ আহরণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আকর্ষণীয় ও প্রসারমান মৎস্যশিল্প। ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল সেখানে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে মোট যে মৎস্য সম্পদ আহরিত হতো, তার ছয় ভাগের এক ভাগ যোগাত আরল সাগর। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদেরই তৈরি করা ২০ হাজার মাইল খাল, ৪৫টি বাঁধ ও ৮০টি জলাধারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে আরল সাগরকে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×