ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কালের বিবর্তনে কমেনি আবেদন বাংলা গণসঙ্গীত প্রসারে উদ্যোগ দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ জুন ২০১৫

কালের বিবর্তনে কমেনি আবেদন বাংলা গণসঙ্গীত প্রসারে উদ্যোগ দাবি

গৌতম পাণ্ডে ॥ বাংলা গণসঙ্গীত মূলত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শোষণ, নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণমানুষকে উদ্দীপ্ত করার গান। বাঙালী জাতির দুঃসময়ে গণসঙ্গীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পঞ্চাশের জেল বিদ্রোহ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, সাতান্নর কাগমারির সাংস্কৃতিক সম্মেলন, বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সাতষট্টি-আটষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালী জাতিকে সাহস যুগিয়েছে গণসঙ্গীত। কিন্ত সাম্প্রতিক গণসঙ্গীতের সেই আবহ কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের কয়েকজন বরেণ্য গণসঙ্গীত শিল্পী, রচয়িতা ও সংগঠকবৃন্দ। এদের কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনকে দায়ী করছেন আবার কেউ কেউ পৃষ্ঠপোষকাতার অভাবের কথা বলছেন । দেশের হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন গণসঙ্গীতকে কিভাবে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় এ ব্যাপারে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ ও ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’র নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে উৎসব, প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গণসঙ্গীতকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এ প্রচেষ্টা নেহায়েতই কম। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, বাংলা গণসঙ্গীত আগের মতো ভূমিকা রাখতে না পারার কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন। রাজনীতির যে অবস্থানে গণসঙ্গীত তৈরি ও চর্চা হয় সে পরিবেশের এখন ঘাটতি রয়েছে। আজ দুঃখজনক হলেও বলতে দ্বিধা নেই যে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ২৩ বছরের সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে যে গান দিয়ে, আজ পর্যন্ত সে গানগুলো আমাদের দেশে সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়নি। বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক সংগঠন ও দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এসব গানকে এড়িয়ে চলেছে। দেখা যায় টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যান্ডসঙ্গীতসহ অন্যান্য সঙ্গীতের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করে কিন্তু গণসঙ্গীতের কোন অনুষ্ঠান করে না। তাহলে এ প্রজন্ম এ সঙ্গীত শিখবে কি করে? বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের পরিবেশটা এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, সত্যিকার অর্থে স্বদেশ মুক্তির জায়গা থেকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। দেশে জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে হাতোগোনা কয়েকটি সংগঠন গণসঙ্গীত তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। গণসঙ্গীতের ঐতিহ্য এত সীমিত নয়, এর গভীরতা অনেক। বিশেষ করে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের বিষয়গুলো কতিপয় গণসঙ্গীতে বিশেষভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। রমেশ শীল, পরিমল দাশগুপ্ত, শাহ আবদুল করিমের মতো প্রতিবাদী শিল্পীরা ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ঔপনিবেশিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গণসঙ্গীতকে বেছে নিয়েছিলেন। বাংলা গণসঙ্গীত আন্দোলন যারা সংগঠিত করে জনতার সংগ্রামী প্রত্যয়কে কালজয়ী সুরের সংমিশ্রণে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সলীল চৌধুরী, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, খালেদ চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুধন্য দাশগুপ্ত, নিবারণ প-িত, কলিম শরাফী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও আমাদের গণসঙ্গীতের সেই সুর অনুসরণ করেই সেই সংগ্রামের পথ বেয়ে ঐতিহ্যবাহী গণসঙ্গীত পরিবেশন করতে হলো স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের পরও। এসব গানের আবেদন আজও শিরায় শিরায় অনুভব করা যায়। গণসঙ্গীত রচয়িতা ও শিল্পী মাহমুদ সেলিম বলেন, গণসঙ্গীত হচ্ছে সময়োপযোগী গান। তবে আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে যখন জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সাম্প্রদায়িক হামলা চলেছে কিংবা পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তখন কিন্তু কিছু মানুষ ও সংগঠন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সোচ্চার হয়েছে গানের মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে আমার লেখা একটি গানও মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। আমার লেখা গানের প্রথম লাইনটি হলো ‘যে মানুষ ক্ষেতে-খামারে সারাদিন খেটে মরে, যে মানুষ তোমার মুখে দিচ্ছে তুলে খাবার, তোমার হয়না সময় তাদের কথা ভাবার, সে মানুষ পুড়লে তোমার কিচ্ছু যায় আসে না’। তিনি আরও বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম না থাকলে গণসঙ্গীত হালে পানি পায় না। কেন গণসঙ্গীত আগের মতো মানুষের মনে দাগ কাটকে পারছে না, এটা গবেষণার ব্যাপার। মূলত বাইরের সংস্কৃতির প্রভাবে নতুন প্রজন্ম বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। তারা বেশিরভাগ সেলফি সংস্কৃতিতে আক্রান্ত হচ্ছে কি না এটা ভাবার বিষয়। এটা যদি হয়, তাহলে তারা দেশকে নিয়ে ভাবতে শিখবে না। ফলে গণসঙ্গীত রচনাও হবে না। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর গণসঙ্গীতকে এককেন্দ্রীভূত না রেখে ছড়িয়ে দিতে চান সর্বজনের মাঝে এবং বিস্তৃত এলাকায় । এজন্য তিনি দেশব্যাপী গড়ে তুলতে চান গণসঙ্গীত একাডেমি। করতে চান সম্মেলনের মাধ্যমে গণসঙ্গীত উৎসব। এক সাক্ষাতকারে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কোন এক সময়ে গণসঙ্গীতের সোনালি দিন ছিল। এর প্রমাণ আমরা পাই ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সে সময়ে গণসঙ্গীতের ভূমিকা ছিল অগ্রে। সে সময়ের অনেক শিল্পী এখন নেই, যাঁরা আছেন তাঁদের কেউ কেউ বিভ্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্নভাবে। সে অর্থে কিছুটা হলেও এর দীনতা যাচ্ছে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এখন আগের মতো গণসঙ্গীত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে পারছে না। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক গণসঙ্গীত রচয়িতা ও শিল্পী প্রবীর সরদার বলেন, গণসঙ্গীতকে আরও জনপ্রিয় করার জন্য উদীচীর পক্ষ থেকে আমরা নিয়মিত গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা, চর্চা, ওয়ার্কসপ ও উৎসব করে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি এ সঙ্গীতের নিজস্ব ধারা বজায় রেখে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এ সঙ্গীতকে সঞ্চারিত করার। তারা যেন বলতে পারে আমি গণসঙ্গীত গাই। আমরা হয়ত আশানুরূপ এ সঙ্গীতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না, কিন্তু থেমে নেই আমাদের কর্যক্রম। গণসঙ্গীতকে আরও এগিয়ে নিতে সমমনা দলসহ সবার এগিয়ে আসা উচিত। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, কালের বিবেচনায় গণসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মৌলবাদবিরোধী সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সাম্প্রতিক জঙ্গীবাদ ও পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারার প্রতিবাদে গণসঙ্গীত নিরন্তর ভূমিকা রেখে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গণসঙ্গীত অতীতে যে ভূমিকা রেখেছিল, সাম্প্রতিক মানবতা বিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে নতুন নতুন গানের মাধ্যমে সে ভূমিকা বজায় রেখে চলেছে। সমাজব্যবস্থায় যখন শ্রেণী বিভেদ, অস্থিরতা এবং অমানবিকতার রাহুগ্রাস আগ্রাসী হয়ে দেখা দেয় তখনই শিল্পী সমাজ তা প্রতিহত করতে গণসঙ্গীতের সুরধ্বনি নিয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। গণসঙ্গীতের এই সুফলকে কাজে লাগিয়ে সমাজে যেন পালা বদলের পালা কার্যক্রম পরিচালিত না হয়ে প্রকৃত অর্থেই গণসঙ্গীতের সঠিক বক্তব্যটির বাস্তবায়ন ঘটে এবং শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থায় সুস্থ সামাজিক পরিবেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিম-ল বিরাজ করে-এই আকাক্সক্ষাই প্রতিটি জনগণের। তাই আমরা সবাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত’।
×