কিছু কিছু শহর আছে যাকে তার নাম ও অতীত দিয়ে চেনা যায়। তেমনি এক শহরে বেড়াতে এসেছিলাম। সিডনি থেকে খুব দূরে নয়। ঘণ্টাখানেকের কিছু বেশি উড়ালে এমন একটি শহরে আসা বিরল অভিজ্ঞতাই বটে। আমাদের দেশে আমরা কি করি? লালবাগের দুর্গ, পরীবানুর মসজিদ, বাহাদুর শাহ পার্ক বা এমন দু’একটি স্থান ঘিরে রেখে বছর বছর চুনকাম করিয়ে বলি : ইতিহাস বেঁচে আছে। দেখে যাও সবাই। কলকাতা বা দিল্লীতেও তাই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা দিল্লী ফোর্ট মানেই কি মোগল আমল বা ব্রিটিশ শাসনের সব আমেজ আর ইতিহাস? আমি যে শহরটায় বেড়াতে গিয়েছি তার আদল তার বহিরাঙ্গিক আর আচরণে এখনও সত্তর দশক বা তার আশপাশের সময় বেঁচে আছে। যে আমলে আমরা ছায়াছবিতে জিনাত আমানকে দেখে দম মারো দম শিখেছিলাম, সে আমলের শহর এটি। দুনিয়ায় একেক সময় একেক ধরনের প্রভাব বা ইমেজ কাজ করে। সেগুলো যখন ব্যাপক হয়ে ওঠে তখন আমরা বলি আন্দোলন। সত্তরের দশকে লম্বা চুল, বেলবটম প্যান্ট আর দড়িপাকানো কেশ গোঁফের মানুষদের নাম ছিল হিপি। এই হিপি আন্দোলন নিঃসন্দেহে এক অনিবার্য ইতিহাস। সে সময় মিডিয়া এমন খোলামেলা ছিল না বলে আমাদের মনে এক ধরনের ভয় কাজ করত। আসলে কি সেই ভয় সঠিক ছিল? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাই ধরুন। যে লোকটি গানে গানে বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেছিলেন, যিনি আমাদের পরম বন্ধু ও হিতৈষী হিসেবে ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন, তার আদল চেহারাও ছিল হিপিসম। জর্জ হ্যারিসনের যুগে এই শহরটিও জেগে উঠেছিল সে নেশায়। ঐ যে হরে কৃষ্ণ হরে রামের কথা বললাম, তারও যোগসূত্র ছিল সে আন্দোলনের সঙ্গে। মূলত দুনিয়ার উন্নত ও আধুনিক নামে পরিচিত দ্রুতগামী দেশগুলোর অসুখ তখন সবে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল। মানুষের অন্তর্গত জীবনে যে বেদনা, না পাবার কষ্ট আর ভাঙ্গনমুখী পরিবারের অসহ্য মনোবেদনা, সেখানেই হরে কৃষ্ণ ও হিপিদের সূচনা। এই শহরটি সেসব স্মৃতি মুছে যেতে দেয়নি।
যেদিন এসে পৌঁছালাম বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আলো-আঁধারিতে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে পথ চলছি আমরা। দু’পাশের দালানগুলো দেখলেই বোঝা যায় সত্তর ও আশির দশক বেঁচে আছে। সিনেমার দৃশ্য বা মঞ্চের মতো সাজিয়ে রাখা বাড়িঘর। আলো তখন নিভু নিভু। সাইকেলে চড়ে সুকেশী লম্বা বিনুনির মেয়েরা ঘুরছে শহরময়। তাদের পোশাক কিন্তু আধা ভারতীয় বা উপমহাদেশীয়। ঢোলা পাজামা আর কুর্তা চাপিয়ে ঘোরা স্বাধীন নব্য হিপিরা হয়ত জানেই না, আমাদের যৌবনে এই আন্দোলন কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম নিরামিষ খাবারের আকর্ষণীয় রেস্তরাঁ। দীপার পছন্দ মাছ বিশেষত থাই খাবার। এ যাত্রায় আমার সঙ্গে ঠিক পেরে উঠতে পারেনি। খাবারের মেন্যু আর সাজানো পদগুলো যেন চোখ ফেরাতে দিচ্ছিল না। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো দেখেই বোঝা গেল, এর সঙ্গে ইসকনের যোগ গভীর। স্বামী প্রভুপাদ থেকে নামকীর্তন সব সুলভের এই দোকানে অর্ডার নেয়া আর সার্ভের কাজ করছিল এক জাপানী। জানা গেল সে কবে বাড়ি ছেড়েছে তার নিজেরও ঠিক খেয়াল নেই। অনেক দেশ হয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার এই শহরে তার আপাত আবাস। জাপানীদের ভেতরও এই আন্দোলন এতটা প্রভাব বিস্তারকারী তা আমার জানা ছিল না। পরদিন ঘুরতে ঘুরতে পথে বসা মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়। কপালে তিলক কাটা, মুখে হরিনাম। সেও জাপানিজ। হিপি শহরের আরেক বৈশিষ্ট্য এর সংস্কৃতি। হওয়ারই কথা। যারা আধপাগলা বা মানুষ, যারা নিজেদের মতো ভাবে না তারাই তো সংস্কারক। আমার-আপনার মতো মানুষরা তো আমজনতা। যেদিকে ঠেলে সেদিকে যাই। আপন মহিমা বা স্বতন্ত্রতা বলে কিছু নেই। এদের আছে। এই শহরে সামনের আগস্টে হতে যাচ্ছে লেখক সম্মেলন। এবারের নির্বাচিত মহান অতিথি পাকিস্তানী তারেক আলী। এ সম্মেলনে এদেশের প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডও থাকবেন লেখক হিসেবে। তবে তার জায়গা তারেক আলীর উঁচুতে নয়। যতদূর মনে পড়ে, মানুষে মানুষে সমতা আর ভালবাসা ভাগাভাগি করার মহান ব্রত নিয়েই এরা মাঠে নেমেছিল। সঙ্গে ঢুকে পড়ে নেশার অবাধ জগত। আজ এতকাল পরে কেন জানি মনে হয়, হয়ত এও ছিল এক ধরনের চক্রান্ত। অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লব আর জগত বদলে দেয়ার ভয়টাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য খোদ আমেরিকাই এ কাজ করে। তার চ্যানেল বা শক্তির ভেতর দিয়েই ঢুকে গিয়েছিল মরণ নেশা।
তারপরও এই শহরে এসে বুঝলাম দুনিয়ায় কোন কিছু মরে না। আজ যারা তার ধারক তাদের ভেতর সে উগ্রতা নেই। সে তেজ বা মেজাজও নেই। এ যেন টগবগে দুধের ওপর পড়া সর। এখন যা দেখছি তা সময়ের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন। আমাদের গোঁফ গজানোর বয়সে যে সব হিরোদের কথা শুনতাম, দোকানে দোকানে তাদের ছবি। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভিজে এসেছিল আমার। সে সব জামা সে আদলের পাতলুন, হাতের ব্যান্ড, গানের সুর মনে হচ্ছিল এখনই কেউ ডাক দেবে আমাকে : চল অমুকের বাসায় গিয়ে বনিএম বা ক্লিফ রিচার্ডের গান শুনে আসি। আমাদের যৌবনে রাজনীতি এতটা উগ্র আর ধান্দামত্ত কিছু ছিল না। স্বপ্নবান মানুষের জীবন ছিল নানামুখী। সে স্বপ্নের এমন ধারণ বা পুরো শহরকে এভাবে ধরে রাখা সত্যি অভাবনীয়। সবচেয়ে বড় কথা, নিরাপত্তা আর ভালবাসার সমন্বয়। এ দুটোর একটা বিঘিœত হলেই কিন্তু সৌন্দর্য বা ফ্লেভার চলে যায়। বাইরন বে-তে এসে আমার মনে হলো, খামোখা দু’একটা পণ্য নেশার নামে যৌবনের অবাধ্যতা আর কথিত নৈতিকতার চাপে আমরা সব হারিয়ে এখন এক দিশেহারা জাতি। একবার ভাবছি, আধুনিকতায় মুক্তি, আরেকবার ভাবি সংস্কারে। তবে এটা ঠিক, মুক্তবুদ্ধি অতীতের প্রতি সম্মান আর নিরাপদ থাকতে পারলেই এমন পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব।
ক্রিকেটের জয় ও ভাবনা
যেদিন আমাদের জবরদস্তি বিদায় করার ফাঁদ পাতা হয়, সেদিন আমি মাঠে ছিলাম। সংখ্যায় কম হলেও আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম সেদিন। জানতাম, অচিরেই এর একটা প্রতিফল পাবে ভারত। কারণ বাংলাদেশ এমন এক দেশ যার কাছে অন্যায় আর অপমান কোনদিন কোনকালে পার পেয়ে যায়নি।
আগে ঘুম ভেঙ্গে বা সকালে উঠে এমন সব খবর পেতাম, যাতে মন ভারি হয়ে উঠত। বিষণœ হয়ে উঠত ভাবনা। আজকাল দিন পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ এখন দিগন্তরেখার মতো ক্রম উদ্ভাসিত। আজ ভোরবেলা অস্ট্রেলিয়ার পূর্বতম প্রান্তের ছোট শহর বাইরন বে-তে আলোর ঝলকানি এসে লেগেছে আমার মনে।
বাংলাদেশীরা সেদিন মেলবোর্নে মন খারাপ করেছিল। নিশ্চয়ই সে বেদনা আজ আনন্দের জোয়ার হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে। ভারত যতই শক্তিশালী হোক তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বরং সমর্থনেই সহযোগী। বিরোধিতায় সে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সঙ্গে এও মনে রাখা উচিত, এক ধরনের সাম্প্রদায়িকরা এর সুযোগে আড়ালে-আবডালে ভারতবিরোধিতার পুরনো আওয়ামী ও প্রগতিবিরোধী ছুরিতে শান দিতে চাইছে। সাধু সাবধান। জয় বাংলা।