ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মার্কিন অর্থনীতি এখনও রোগশয্যায়

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২২ জুন ২০১৫

মার্কিন অর্থনীতি এখনও রোগশয্যায়

আমেরিকার অর্থনীতির অবস্থা এখন কেমন? ২০০৮ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার করাল গ্রাস থেকে এই অর্থনীতি কি পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পেরেছে? পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা দাবি করে থাকেন, আমেরিকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুধু যে ঘটেছে তাই নয়, এই অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চারও হয়েছে। যুক্ত হয়েছে গতিবেগ। তারা বলেন, বাহ্যিক চেহারায় মার্কিন অর্থনীতিকে যতটা হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়, বাস্তবে এই অর্থনীতি তার চেয়েও শক্তিশালী। এই অর্থনীতিতে এখন একই সঙ্গে ভাল ও মন্দ অবস্থা, উত্তপ্ত ও শীতল অবস্থা, আশা ও নৈরাশ্যের অবস্থা বিরাজ করছে। কিছু অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা, শীঘ্র হোক বিলম্বে হোক, আরেক অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত আসতে চলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায় থাকা। মার্কিন অর্থনীতি সেই মন্দা মোকাবেলায় প্রস্তুত? সেই আঘাত সামলানোর ক্ষমতা ও সামর্থ্য কি তার আছে? এ প্রশ্নের কোন দৃঢ় ইতিবাচক উত্তর কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব নয়। কারণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যতটুকু যাই ঘটুক না কেন, এ মুহূর্তে মার্কিন অর্থনীতিকে খানিকটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল সত্য। কিন্তু ইতোমধ্যে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্থনীতির বিভিন্ন জায়গায় ভাঙ্গন ও ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে। এ বছরটা মার্কিন অর্থনীতির যাত্রা ভালভাবেই শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালের শেষ দিকের জোরালো প্রবৃদ্ধি দেখে আইএমএফ বলেছিল, ২০১৫ সালে প্রবৃদ্ধি বাড়বে ৩০১ শতাংশ। তবে মার্চ ও এপ্রিলে খারাপ খবর আসা শুরু হয়। মার্চে সরকারী হিসাবে দেখা যায় যে, বিনিয়োগ ও রফতানি হোঁচট খাচ্ছে। তাতে প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি বছরে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে হ্রাস পেতে থাকে। এরপর আবার সুসংবাদ ফিরে আসে। চলতি জুনের প্রথম দিকের হিসাবে দেখা যায়, প্রথম প্রান্তিকে ঘণ্টা হিসাবে মজুরি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মে মাসে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার। অর্থাৎ দুটো সংখ্যাই পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক ভাল। তথাপি কিছু অর্থনীতিবিদের ধারণা, আমেরিকা মন্দাপূর্ববর্তী ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারে কখনই ফিরে যেতে পারবে না এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির বৃত্তে আটকে থাকেব। এদিকে আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, ২০০৭ সালের পর থেকে এই প্রথম এ বছর প্রতিটি অগ্রসর অর্থনীতির দেশে প্রবৃদ্ধি সার্বিকভাবে ২.৪ শতাংশ হারে হতে পারে। তবে মার্কিন প্রবৃদ্ধির দিক থেকে গতিবেগ সৃষ্টি না হলে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার থেমে যেতে পারে। মার্কিন প্রবৃদ্ধির ওপর যে নির্ভর করা যায় না, তার লক্ষণ হিসেবে তারা ভোগব্যবহারে একটানা দুর্বলতা এবং সঞ্চয়ের হার বেড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ছিল ব্যারেলপ্রতি ১০৪ ডলার। জানুয়ারি ১৫-তে তা নেমে আসে ৪৭ ডলারে। এমনিতে এটা ভাল সংবাদ হওয়ার কথা। কিন্তু যেসব তেল কোম্পানির বদৌলতে আমেরিকা আজ বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদকে পরিণত হয়েছে, সেগুলোর জন্য খবরটা মোটেও শুভ নয়। এসব কোম্পানির সক্রিয় তেল রিগের সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমান কূপগুলোর তেল উত্তোলন গুটিয়ে নেয়া ছাড়াও নতুন বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খনিশিল্প এবং তেল ও গ্যাসকূপে বিনিয়োগ কমেছে দুই হাজার কোটি ডলার তথা ১৫ শতাংশের বেশি। তেলের দাম কমলে ভোগ্যপণ্যের দাম কমার কথা। পরিবহন ব্যয় হ্রাসের কারণে এবং পাশাপাশি এসব পণ্যের বিক্রি ও ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। তবে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। ২০১৪-এর মে মাসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১.৭ শতাংশ। এখন তা শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। ওদিকে ডলারের দাম বেড়েছে। বাড়ার কারণ যাই থাক না কেন, এর কারণে রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি হ্রাস পেয়েছে বার্ষিক ৭.৬ শতাংশ হারে। এতে করে আমেরিকার চলতি হিসাবের ঘাটতি এখন দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি ডলার, যা জিডিপির ২.৪ শতাংশ। এক বছরে এই ঘাটতি বেড়েছে ৩০ শতাংশ। রফতানি হ্রাস পাওয়ায় কর্পোরেট মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই মুনাফা হ্রাস পেয়েছে ১২ হাজার ৫৫০ কোটি বা ৫.৯ শতাংশ এবং সেটা ঘটেছে ২০১৪ সালের শেষ প্রান্তিক থেকে ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। অবশ্য ইতোমধ্যে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি থেমে গেছে এবং খানিকটা হ্রাসও পেয়েছে। শিল্প উৎপাদনের চেহারাটা মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। জানুয়ারি থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন টানা পাঁচ মাস হ্রাস পেয়েছে। মার্চ ও এপ্রিলের মধ্যে এই উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বার্ষিক ৩ শতাংশ হারে। এ ধরনের তথ্য বিভিন্ন খাত থেকে আসতে থাকলে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, মার্কিন অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়াটা সাময়িক। আমেরিকার মুদ্রাবাজারে যে অবস্থা বিরাজমান, তা দেখে এ কথা বলার উপায় নেই যে, সেখানে সুদের হার অত্যধিক। তহবিলের চাহিদা কম থাকা তো দূরের কথা, বরং ঋণগ্রহণ বেড়ে চলেছে। কোম্পানিগুলো রেকর্ড হারে ঋণ নিচ্ছে। ২০১৫ সালের এ পর্যন্ত ৬০ হাজার ৯শ’ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ৪ হাজার কোটি ডলার বেশি। অর্থাৎ প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ফেডারেল রিজার্ভ এ বছরের শেষ দিকে সুদের হার বাড়াবে বলে শোনা যাচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে সেটা হবে ২০০৮ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো সুদের হার বৃদ্ধি। সুদের হার বাড়ানো হলে তার প্রভাব সবার ওপর এসে পড়বে। যারা বাড়ি বন্ধক রেখেছে, গাড়ি কেনার ঋণ নিয়েছে, যাদের সঞ্চয়ী হিসাব আছে বা শেয়ারবাজরে টাকা খাটিয়েছে, তাদের সবার ওপরই প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে যারা সঞ্চয় করেছে তারা কিছু লাভবান হবে এবং যারা ঋণ নিয়েছে তারা হবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিগত আর্থিক বিপর্যয়ের পর থেকে যারা ব্যাংকে টাকা রেখেছে, তারা বলতে গেলে কিছুই পায়নি। সুদের হার অতি কম থাকায় তাদের কোন প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি। এ অবস্থায় সুদের হার বাড়লে সঞ্চয়কারীরা তাদের আমানতের ওপর বাড়তি সুদ পেয়ে লাভবান হবে। পক্ষান্তরে ঋণগ্রহীতাদের বাড়তি সুদের টাকা গুনতে হবে। এতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লোকে ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে টাকা খাটাতে নিরুৎসাহিত বোধ করবে। মাঝারি আকারের প্রবৃদ্ধি ঘটা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেশ বেড়েছে। কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ আয় বা মুনাফা করেছে, তাতে শেয়ারের দাম এত বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণটা অন্য জায়গায়। তা হলো, সাারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে শেয়ারে খাটানোই যৌক্তিক মনে করেছে এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এখন সুদের হার বাড়ানো হলে ব্যাংক আমানতে ও বন্ডে বিনিয়োগ লোকের কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় হবে। ফলে তারা শেয়ার ছেড়ে বন্ড ইত্যাদির দিকে ঝুঁকবে। ফলে শেয়ারবাজারে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দেবে। আমেরিকার আরেকটি ক্ষেত্রের চিত্রও উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, সে দেশের শ্রমের উৎপাদনশীলতা থেমে আছে। চলতি জুনের প্রথম দিকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-এর শেষ প্রান্তিক থেকে ২০১৫-এর প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি উৎপাদন ৩ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আমেরিকা যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি, এটাই তার প্রমাণ। সুতরাং এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মার্কিন অর্থনীতি এখনও নাজুক অবস্থায়। তেমনি নাজুক অবস্থায় রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোজোনের মধ্যকার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের ফলে তাদের মুদ্রানীতিতেও বিপজ্জনক ভিন্নমুখিতা দেখা দিতে শুরু করেছে। এর পরিণতিতে মার্কিন ডলারের দাম বাড়ছে এবং ইয়েন ও ইউরোর দাম কমছে। ডলারের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি এবং তেলের দরপতনের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। এ কথা সত্য যে, গত মে মাসে আমেরিকায় ২ লাখ ৮০ হাজার কর্মসংস্থান বেড়েছে। তারপরও সেখানে বিপুলসংখ্যক বেকার রয়ে গেছে, যারা সক্রিয়ভাবে চাকরি খুঁজেও পাচ্ছে না। পূর্ণাঙ্গ সময়ের চাকরির সন্ধানে থাকা লোকের সংখ্যা হবে প্রায় ৩৫ লাখ। এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের চাকরির বাজার ১৯৯৯ সালের পর থেকে ২০১৪ সাল ছিল সাফল্যের সেরা বছর। তথাপি শ্রমিকের মজুরি তেমন একটা বাড়ছে না। ফলে আমেরিকানরা খুব একটা বাইরে বের হচ্ছে না এবং খরচ করছে না। তা থেকে বোঝা যায়, ভবিষ্যত সম্পর্কে তাদের মধ্যে আস্থার অভাব আছে। তেল ও গ্যাসের দাম অনেক কমেছে। এর ফলে লোকজনের যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়িয়ে পয়সা খরচ করার কথা। কিন্তু তারা তা না করে সঞ্চয় করছে বা সঞ্চয় আঁকড়ে আছে। খুচরা বিক্রি ও আবাসন নির্মাণ কমে এসেছে। দোকানদার ও বিনিয়োগকারীরা ‘দেখা যাক কী হয়’ নীতি অবলম্বন করেছে। ব্যবসায়ীরা রেকর্ড মাত্রার নগদ অর্থের ওপর বসে আছে। তা থেকে বোঝা যায় যে, বড় ধরনের অর্থ ব্যয়ে তারা তেমন আস্থা পাচ্ছে না এবং উৎসাহবোধও করছে না। এই লক্ষণগুলো ভাল নয়। এ থেকে অর্থনীতিতে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ওঠে, গতিবেগ হারিয়ে ফেলার ভাব দেখা যায়। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট
×