ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুস্তাফিজের সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস হয়ে উঠার কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২১ জুন ২০১৫

মুস্তাফিজের সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস হয়ে উঠার কাহিনী

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ সাতক্ষীরা থেকে মিরপুর স্টেডিয়াম। আর অভিষেক ম্যাচে জাদু দেখিয়ে সে এখন সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস। সাতক্ষীরাবাসীর কাছে মুস্তাফিজ এক সুন্দরবনের বাঘের গর্জন। জেলাবাসী তার নাম দিয়েছে সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস। মুস্তাফিজ নাটকে বধ হয়েছে ধোনির দল। দেশজুড়ে এখন মুস্তাফিজ বন্দনা। মুস্তাফিজ এখন সাতক্ষীরা তথা দেশের গর্ব। বাঁহাতি পেসার। ইন সুয়িং, আউট সুয়িং, ওভারে একটি দুটি রির্ভাস সুয়িং। পাকিস্তানের পেস বোলার আমিরের মতো বোলিং স্টাইল ইন সুয়িং আউট সুয়িংয়ের ভেলকি দেখিয়ে টি২০তে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল করেন এই তরুণ বোলার। জাতীয় দলে খেলার পর সে সাতক্ষীরাবাসীর কাছে হয়ে উঠে নয়নের মণি। বৃহস্পতিবার ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে সে এখন ক্রিকেট বিশ্বে নতুন বিস্ময়। তার গ্রামের বাড়িতে চলছে আনন্দ উৎসব। তার বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছে নানান শ্রেণী-পেশার মানুষ। তার বাবা-মাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সকলে। সাতক্ষীরার রবিউল ইসলাম শিপলু ও সৌম্য সরকারের পর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ উঠল মুস্তাফিজুর রহমানের মাথায়। যশোর জেলার ছেলে সৈয়দ রাসেলের পর আবার একজন বাঁহাতি ফাস্ট বোলার পেল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। মুস্তাফিজুর রহমান নামে ১৯ বছর বয়সী উঠতি গতি তারকার অভিষেক হলো ভারতের বিরুদ্ধে। গত বছরের এপ্রিলে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় মুস্তাফিজের। সাতটি ম্যাচ খেলে ৫টি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলা মুস্তাফিজুর ৩.৪৫ ইকোনমি রেটে ১২টি উইকেট দখল করেছেন। ফাস্ট ক্লাস এবং লিস্ট-এ একবার করে ৫ উইকেট লাভ করছে সে। এর আগে অভিষেক হয় ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে। ৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ থেকে তার ঝুলিতে নেন ২৩টি উইকেট। তারপর অনুর্ধ-১৯ দল ও ‘এ’ দলের হয়ে দারুণ বোলিং করে নজর কাড়ে বিচারকদের। এছাড়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খুলনার হয়ে মাত্র আট ম্যাচ খেলেই পেয়েছেন ২৩ উইকেট। গড় ১৮.৯১, ইকোনমিক রেট ২.৬৮। আর লিস্ট-এ তে আবাহনীর পক্ষে ৫ ম্যাচে উইকেট ১২টি। গড় মাত্র ১১.৭৫, ইকোনমিক রেট ৩.৪৫। অভিষিক্ত এই বোলার নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের ছেলে মুস্তাফিজ বরেয়া জিলানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। অনুর্ধ ১৬, ১৮ ও ১৯ সাতক্ষীরা জেলা দলের খেলোয়াড় তিনি। ব্যবসায়ী বাবা আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে মুস্তাফিজ। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে তার জন্ম। সংসারে চার ভাই ও দুই বোন। তার বড় ভাই গ্রামীণফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, মেজ ও সেজ ভাই ঘের ব্যবসায়ী। তার ক্রিকেট খেলায় আসার পিছনে সেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান অনেক। তার বড় ভাই এক সময় ক্রিকেট খেলতেন, মেজ ভাইও কম যান না, আর সেজ ভাই এখনও ক্রিকেট খেলেন। তার সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান লাল্টু জানালেন, তার উঠে আসার ইতিহাস। এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। সাতক্ষীরায় অনুর্ধ-১৪ ক্রিকেট বাছাই পর্বে মুস্তাফিজ নজর কাড়ে সবার। সেখান থেকে তার ক্রিকেট জীবনের পথচলা শুরু। এরপর জেলাপর্যায়ে অনুর্ধ-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। পড়াশোনায় অতটা মন তার কখনই ছিল না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতে যেত। এরপর থেকে ক্রিকেটই তার ধ্যানজ্ঞান। বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ। জেলাপর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে খেলার। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনুর্ধ-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। তবে সম্ভাবনার দ্রুতি ছড়িয়েছেন গত বছর অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে। তার ঝুলিতে ভরেছিলেন ৯ উইকেট। হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণীতে খেলা শুরু করেন গত বছর এপ্রিলে। ছয় মাস আগে অভিষেক হয় ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচে। অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স তাই বাংলাদেশ দলে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়Ñ নতুন বিস্ময় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবির্ভূত হলেন এই তরুণ পেসার। ছোট্ট এ ক্যারিয়ারে উজ্জ্বল পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে মুস্তাফিজ কতটা প্রতিভাধর। এখন তার প্রতিভার বিকাশ দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। ১৯ বছর বয়সী সেই আশার গানই শোনালেন অভিষেকে। বাঁহাতি পেসারের যে ঘাটতি চলছিল বাংলাদেশ দলে সে ঘাটতি হয়ত পূরণ করতে সক্ষম হবেন এই সাতক্ষীরা এক্সেপ্রেস। তাছাড়া মুস্তাফিজের স্বপ্ন পূরণে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন তার বাবা-মাসহ গোটা জেলাবাসী। মুস্তাফিজের বাবা আবুল কাশেম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে যে জাতীয় টিমে খেলছে এটি গর্বের বিষয়। তিনি আরও বলেন, মুস্তাফিজ আজকে আমার একার ছেলে নয়Ñ সে গোটা জাতির হয়ে ২২ গজের রণাঙ্গনে লড়বে।
×