ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে ব্র্যান্ড মোটরসাইকেল

মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্প বন্ধের উপক্রম

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২১ জুন ২০১৫

মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্প বন্ধের উপক্রম

কাওসার রহমান ॥ মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে সবারই প্রথম পছন্দ ব্র্যান্ড। কেউ বাইক কেনার কথা চিন্তা করলেই প্রথমে চলে আসে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পূরক শুল্ক হার একলাফে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে সেই ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশীয় যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মোটরসাইকেল শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর বাজেটে উচ্চ সম্পূরক শুল্কারোপ করা হয়েছে তারা এখনও ১০ শতাংশের বেশি বাজার দখল করতে পারেনি। দেশের মোটরসাইকেলের ৯০ শতাংশ বাজারই বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের দখলে। এতদিন এই শুল্ক পার্থক্য থাকার কারণেই দেশে ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের সংযোজন কারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পূর্ণ তৈরি মোটরসাইকেল ও বিযুক্ত অবস্থায় মোটরসাইকেলের সম্পূরক শুল্ক সমান করার কারণে দেশে গড়ে উঠা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের সংযোজন কারখানাগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, ব্র্যান্ড মোটরসাইকেলের সংযোজন শিল্পের দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগও হুমকির সম্মুখীন। ৫০ হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোটরসাইকেলের সংযোজন শিল্পের ওপর দুটি আঘাত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, এদেশে সংযোজন করার জন্য বিযুক্ত অবস্থায় আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের শুল্ক হার সম্পূর্ণ তৈরি মোটরসাইকেলের সমান করা হয়েছে। আগে সম্পূর্ণ তৈরি মোটরসাইকেলের সম্পূরক শুল্ক হার ছিল ৪৫ শতাংশ। আর বিযুক্ত অবস্থায় আমদানিকৃত মোটরসাইকেলের সম্পূরক শুল্ক ছিল ৩০ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এই শুল্ক হার সমান অর্থাৎ ৩০ শতাংশ শুল্ক হার ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিযুক্ত অবস্থায় অর্থাৎ খোলা অবস্থায় মোটরসাইকেল আমদানির ক্ষেত্রে রং বিহীন অবস্থায় আমদানির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন বলে এতদিন রং করা অবস্থায় আমদানি করা যেত। এখন ১৮ বছরের পুরনো নীতি পরিবর্তনের কারণে স্থানীয় সংযোজন শিল্পগুলোকে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ রং করার জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। নতুন করে পেইন্টিং কারখানা স্থাপন করতে হলে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। নতুন এই বিনিয়োগ না করতে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেছে মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোটার্সন এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি হাফিজুর রহমান খান। আবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যেসব পেইন্টিং কারখানা স্থাপন করা হয়েছে তাতে ৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল রং করা যাবে না। আর সংযোজন শিল্পের জন্য রং কারখানা স্থাপন করতে হলে বিনিয়োগ করতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা এই বাজার ব্যবস্থায় মোটরসাইকেল উৎপাদনকারীদের জন্য ব্যবসার বাধা হতে পারে। তাই ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে রংসহ মোটরসোইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে ছাড় দেয়া আরও কিছুদিন বহাল রাখা প্রয়োজন। এতে চলমান আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দেশের মোটরসাইকেলের যন্ত্রাশ রং করার কারখানাগুলো চালু করা সম্ভব হবে। জানা যায়, মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডগুলো ১৫ শতাংশ শুল্ক পার্থক্য এবং রং করা অবস্থায় আমদানির সুযোগ নিয়ে এদেশে মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্প গড়ে তুলেছে। ইয়ামাহা, বাজাজ, হিরো, টিভিএস, সুজুকি প্রভৃতি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি সর্বশেষ জাপানি হোন্ডা ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে অর্থ বিনিয়োগ করে মোটরসাইকেল উৎপাদনের সংযোজন কারখানা গড়ে তুলেছে। এ সকল নামিদামি কোম্পানি বিদেশ থেকে রং করা যন্ত্রাংশ দেশে এনে মোটরসাইকেল তৈরি করে বাজারজাত করছে। এভাবে দেশে প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে বছরে তিন লাখ মোটরসাইকেল। কিন্তু আগাম কোন ঘোষণা না দিয়ে আগামী অর্থবছর থেকে হঠাৎ সরকারের বিনিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করার কারণে বিপাকে পড়েছে ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল সংযোজনকারী শিল্পগুলো। ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে প্রতিটি মোটরসাইকেলের মূল্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এতে মোটরসাইকেলের বাজার সংকুচিত-ই হবে না, সংযোজন শিল্পগুলোও মুখ থুবড়ে পড়বে। বর্তমানে মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্পে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিযুক্ত অবস্থায় তথা খোলা অবস্থায় (সিকেডি) মোটরসাইকেল আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। তার পরিবর্তে সম্পূর্ণ তৈরি অবস্থায় মোটরসাইকেল আমদানি বৃদ্ধি পাবে। এতে সংযোজন শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে ৫০ হাজার শ্রমিক কর্মচ্যুত হবে। দেশ আবার ‘ট্রেডিং নেশনে’ পরিণত হবে। ইতোপূর্বে এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিএনপির প্রায়ত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। আশির দশকে সরকার টেলিভিশন আমদানির ক্ষেত্রে সিকেডি ও সিবিইউর আমদানি শুল্ক পার্থক্য ২০ শতাংশ করে দিয়েছিল। ফলে দেশে ব্যাপকভাবে টেলিভিশন সংযোজন কারখানা গড়ে উঠে। ক্রমেই সেই সংযোজন শিল্পের প্রাসর ঘটছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯৫-৯৬ সালের বাজেটে সাইফুর রহমান টেলিভিশন আমদানির ক্ষেত্রে সিকেডি ও সিবিইউর শুল্ক হার সমান করে দেন। ফলে দেশে গড়ে উঠা টেলিভিশন সংযোজন শিল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। দু’একটি ছাড়া প্রায় সব টেলিভিশন সংযোজন শিল্পই বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া পুনরায় টেলিভিশন আমাদনির ক্ষেত্রে সিকেডি ও সিবিইউর আমদানি শুল্ক পার্থক্য ৩০ শতাংশ করে দেন। এতে আবার দেশে টেলিভিশন কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। বর্তমানে দেশে টেলিভিশন কারখানার যে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে তা মুলত অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার নীতিগত সহায়তারই ফসল। দেশে গড়ে উঠা মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্পের ক্ষেত্রেও ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এই প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে দেশে গড়ে উঠা ব্র্যান্ড মোটরসাইকেলের সংযোজন কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিটি মোটরসাইকেলের দাম ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশে সংযোজনের পরিবর্তে বিদেশ থেকে তৈরি মোটরসাইকেল আমদানি বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, দেশে বার্ষিক মোটরসাইকেলের চাহিদা হচ্ছে দুই লাখ। এই চাহিদার ৯০ শতাংশই যোগান দিচ্ছে ব্র্যান্ড মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলো। বাকি ১০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোটরসাইকেল দিয়ে। সরকার গত পাঁচ বছর ধরে স্থানীয় কয়েকটি মটরসাইকেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে সংরক্ষণ দিয়ে আসছে।
×