ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাবা তোমাকে...

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২১ জুন ২০১৫

বাবা তোমাকে...

ফজরের নামাজ শেষে দিনের আলো ফোটার সময়টাতে বেরিয়ে পড়েন হাঁটতে বাবা। সঙ্গে থাকেন স্ত্রী এবং ছোট মেয়েটা। বাবার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে খেজুরবাগান পার হয়ে বিজয় সরণি পর্যন্ত গেলেই ক্রিসেন্ট লেক। রাস্তা পার হওয়ার সময় বারবার মেয়েটি ভয় পায়। বলে, ‘বাবা গাড়ি চলে আসছে তো!’ কিন্তু বাবা আশ্বাস দেন, গাড়িটা চলে গেলেই রাস্তা যখন ফাঁকা থাকবে তখনই রাস্তা পার হতে হবে। কখনই তাড়াহুড়া করা যাবে না। প্রতিদিন সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করেন- ‘স্থপতির নামটা বলো।’ ছোট মেয়েটি বলে- ‘লুই আই কান’। তারপর বলে ঐ যে হলুদ হলুদ ঝুমকোর মতো ফুল ফুটে আছে, গাছটার নাম বলো? মেয়েটি বলে, ‘সোনালু গাছ।’ এভাবে একটার পর একটা গাছ সামনে আসতে থাকে। এভাবে কত গাছ, ফুল, পাখির নাম শেখা, পথ চলতে শেখা। বাবার হাঁটার ছন্দের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে প্রায় ছোট ছোট পাগুলো ক্লান্ত হয়ে পিছিয়ে যেত। তখন বাবা বলতেন, ‘দেখো, একদিন আমি আর তোমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারব না। আমাকেই তখন পিছিয়ে পড়তে হবে।’ আসলেই তাই, ছোট বড় হয়ে যায়, নতুনের জন্ম দিয়ে যায়। এভাবেই পথচলা জারি থাকে, শুধু পদশব্দগুলো পাল্টে যায়। আমার বাবা আমাকে হাঁটতে শিখিয়েছেন। প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে বলতেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র।’ হেমন্তের ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মাঝে আমাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন বুড়িগঙ্গা নদীতে। ছোটবেলায় দেখা নদী আর আজকের নদী তার হৃদয়ে ভীষণ ক্ষরণ তৈরি করত। একদিন ক্রিসেন্ট লেকের এক কোনায় আমরা একটা উঁই পোকার ঢিবি আবিষ্কার করলাম। সেদিন প্রাতঃভ্রমণ বাদ দিয়ে উঁই পোকা নিয়ে কতকিছু যে বললেন আমার বাবা! মাটির প্রতি, সৃষ্টিশীলতার প্রতি, হতে পারে তা নিতান্ত কীটপতঙ্গ, তবুও তিনি সেই সৃষ্টিশীলতা দেখতেন মুগ্ধ হয়ে। আমাদের সময় তো আর গুগল বা ইউটিউব ছিল না। কিন্তু আমার বাবাই একজন বায়োলজিক্যাল গুগলের মতো আমাকে তার ইনফরমেশনগুলো শেয়ার করতেন। বায়োলজিক্যাল গুগল এজন্যই বলছি, কারণ, কম্পিউটার আমাকে কেবল ইনফরমেশন দেবে আর বাবা আমাকে ইনফরমেশনের পাশাপাশি ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাটাও দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায় তিনি গিয়েছেন কর্মসূত্রে। আমার বাবা যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন কৃষি ভবন ও সেচ ভবন ডিজাইনের এ্যাডভাইজার বোর্ডে এবং ভবন নির্মাণ কাজের দায়িত্বে। সংসদ ভবনের ঠিক বিপরীতে সেচ ভবন। তাই সেচ ভবনের পাশ দিয়ে যখনই আমি যাই মনে হতে থাকে আমার বাবার কথা। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক মজুদ ও বিপণনের জন্য নিরলস কাজ করেছেন তিনি। নির্মাণে নিয়োজিত ছিলেন বহু গুদাম এবং সরকারী ফার্ম হাউসে। মনে পড়ে যশোরের দত্তনগরে প্রায় পরিত্যক্ত একটি স্থান আমার বাবার উদ্যোগেই পরিণত হয় ফার্ম হাউসে। যেখানে নিয়োগ পান বহু কর্মী এবং উৎপাদিত হয় মৌসুমী শস্য। সরকারী বৃত্তিতে যুক্তরাজ্যের টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঝড়ঁঃযধসঢ়ঃড়হ-এ পড়ালেখা করেছেন সেচ গবেষণার ওপর। কিন্তু দেশের টানে, মাটির টানে আবার ফিরে এসেছেন প্রবাসের বিলাসী জীবন পরিত্যাগ করে। যেসব স্থানে সেচের সুব্যবস্থা নেই নিজে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে সেসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের দায়িত্ব তিনি পালন করেন নিরলসভাবে। বাবার কাছে বারবারই মনে হতো বাংলাদেশে কৃষিখাতে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। কৃষিতে সমৃদ্ধি আনতে হলে প্রয়োজন সেচ। আর তাই উন্নত ডিগ্রী শিক্ষাকে তিনি সার্টিফিকেটে বন্দী করে রাখেননি। এক সময় কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর সমসাময়িকরা যখন নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সিতে ব্যস্ত, তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর জন্মভূমি দুর্গম উপকূলীয় এলাকা সন্দ¦ীপের জন্য কিছু করার কাজে। একটা গাছও যদি কেটে ফেলা হয় তাহলেও বিপর্যস্ত হয় পরিবেশ। আমার বাবা নিজ দায়িত্বে তার জন্মস্থানে রোপণ করেছেন দশ হাজারেরও বেশি গাছ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষীয়ান শিক্ষক ড. রশিদ এবং ড. নাজমুল হক স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলেন বাবা। তাই খড়ি ঈড়ংঃ ঐড়ঁংরহম-এই কনসেপ্ট নিয়ে তৈরি করেছেন দুর্যোগকবলিত গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়স্থল। এভাবেই কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জনের বাইরে থেকে কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার এই নিরলস শ্রম তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। নাথালিয়ান কান তার বাবাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন, যেখানে তার বাবা লুই আই কানের কাজগুলো তুলে ধরা হয়। আমি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলার তাগিদ থেকেই আজ লিখতে বসেছি। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার এমএ কালাম একজন ভাল মানুষ। যিনি তার দেশকে ভালবাসেন, প্রকৃতিকে ভালবাসেন আর ভালবাসেন বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষককে। যারা নিরলস শ্রম দিয়ে ফসল ফলায়, যাদের ঘামে এবং মেহনতে আমাদের খাবার টেবিল সেজে ওঠে প্রতিদিন। বাবা তোমাকে জানাই অন্তহীন শ্রদ্ধা। [email protected]
×