ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

রানার-রানার...

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২১ জুন ২০১৫

রানার-রানার...

কলেজে পড়ার সময় সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার কবিতাটি পড়ার প্রথম সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক বিভাগে আমরা ক’জন মুগ্ধ হয়ে আমাদের সহপাঠী অন্যদের মধ্যে বদরুল হক (পরে বিচারপতি, প্রয়াত) ও জিয়াউদ্দিন আহম্মদের (পরে ব্যারিস্টার, প্রয়াত) কণ্ঠে রানারের আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। ক’দিন পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এই কবিতাটি গান অবয়বে আমাদের সকলকে মোহিত করেছে। বার বার শুনেছি সে গান, আন্দোলনের বিরতিতে, পাঠের মাঝখানে, নির্ঘুম রাতের আঁধারে। এই গান গণআন্দোলনের সেই যুগে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছে। তৎকালীন স্বৈরশাসনের নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার ও শোষণের পটে তরুণের স্বপ্ন নিয়ে হৃদয়ের স্পন্দনে আশা করেছি নতুন দিনের, যেমনি আশা করেছিলেন সুকান্ত; ‘দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি- নেই দেরি, নেই আর, ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে দুর্দম, হে রানার।’ এই সময়ে আমার এক ভগ্নিপতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ডাকঘরপ্রধান ছিলেন। হাজীগঞ্জ হয়ে গুলবাহার গ্রামে বাড়ি যাওয়ার পথে এক সকালে দেখেছিলাম, আমার বড় বোন তার রান্নাঘরের বারান্দায় পাটি পেতে লুঙ্গি পরা খাকি হাফশার্ট গায়ে একজন ডাককর্মীকে সকাল ১০টার দিকে স্নেহভরে খেতে দিয়েছেন। টিনের বাসনে দু’মুঠো ভাত, পুঁটি মাছ সংবলিত বাসি তরকারি ও ডাল, আরেকটি পোড়া মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পরম তৃপ্তিভরে নিঃশব্দে খাচ্ছেন তিনি। একটি কাঁটাও না ভেঙ্গে পুঁটি মাছের সর্বাংশ অপূর্ব যতœ ও কৌশলে তিনি ভাত-তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে নিচ্ছিলেন। মনে হলো, সৃষ্টিকর্তার নিয়ামতকে অতীব যতেœর সঙ্গে প্রাপ্তির সন্তোষে ম্রিয়মাণ হয়ে খাবার হিসেবে কাঁটা ছাড়ানো মাছ-ভাত মুখে তুলছেন তিনি। আপার কাছে শুনলাম, ইনিই হলেন তাদের প্রিয় রানার রহিম। ভোরবেলা মূল ডাকঘরে ডাক পৌঁছে দেয়ার পর তিনি সব দিন স্বপ্রণোদিত হয়ে আপার সংসারের কাঁচাবাজার করে দেন। ভোর রাতে নদী-বিলে ধরা বাজারে আসা তাজা মাছ বেছে কিনে আনতে তার মতো দক্ষ কেউ নাকি নেই। তার খাওয়ার পর ডাকঘরের ভেতরে একটি প্রায় জানালাবিহীন কামরায় এই রানারসহ গিয়ে দেখলাম, সেখানে তার আরও ৬-৭ জন সহকর্মী একই পোশাকে গল্পগুজব করছেন। এরা রানারের ভূমিকায় এলাকার মূল ডাকঘর থেকে ক্যামবিসের পানিরোধক বড় হলদেটে খাকি রংয়ের জামবো ব্যাগ ভরে গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন ছোট ডাকঘরে চিঠির বোঝা নিয়ে যান এবং তেমনি করে সেখান থেকে ফিরতি চিঠির বোঝা বয়ে মূল ডাকঘরে পৌঁছে দেন। সেই সময় এই ডাকের বোঝার মধ্যে চাকুরে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের শহর থেকে গ্রামে স্বজনদের কাছে পাঠানো মানিঅর্ডারও থাকত। মানিঅর্ডারে উল্লিখিত নগদ টাকা মূল ডাকঘর থেকে প্রত্যন্ত এলাকার ডাকঘরে নিশ্চিন্তে পৌঁছে দিতেন রানার। তার জীবনের প্রাত্যহিক ও নিদারুণ অভাব সত্ত্বেও পিঠেতে যে টাকার বোঝা নিয়ে গেছেন গ্রামান্তরে তা তিনি ছুঁতে পারেননি, ছুঁতেও চাননি। একাগ্র সততার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে তার পথচলা আর আচরণ। তাদের একেকজনকে একেক দিন এক পথে প্রায় ৮ মাইল এবং দু’পথ মিলে ১৬ মাইল পথ অতিক্রম করে অর্পিত কাজটি সম্পন্ন করতে হতো। এভাবে চলার জন্যই সম্ভবত তাদের দোহারা গড়ন, কারও দেহে কোন মেদের নিশানা নেই। শুনলাম প্রথাগতভাবে মূল অফিস থেকে তাদের নেয়া ডাকের বোঝা ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছাতে হয়। সকাল ৮টার আগেই আবার ডাক নিয়ে তাদের মূল ডাকঘরে ফেরত আসতে হয়। সেজন্যই এই আলো-আঁধারিতে চলার প্রেক্ষিতেই সুকান্ত লিখেছিলেন : ‘অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিটিমিটি করে চায়; কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!’ শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে যখন এই উপমহাদেশে ডাক সার্ভিস প্রচলিত ও বিস্তৃত হয়, তখন এই রানারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল সকালে সূর্য ওঠার আগেই মূল ডাকঘর থেকে প্রত্যন্ত এলাকার নির্দিষ্ট ডাকঘরে ঐ ক্যামবিসের ব্যাগে করে ডাক পৌঁছানো এবং সেখান থেকে যথাসম্ভব দ্রুত সে ডাক মূল ডাকঘরে নিয়ে আসা। সরকারের নিম্নতম পদের কর্মচারী হয়েও এই রানাররা নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, সততা ও সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যবোধের স্বাক্ষর যুগ যুগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে জনমানবহীন বনপথে যাওয়া এক রানার তার সামনে দাঁড়ানো এক বাঘকে অসীম সাহসে হাতের বল্লমসদৃশ লাঠি নিয়ে এগিয়ে এসে সরিয়ে দিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। এখনকার ডাক বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের থেকে জানা গেছে, রানারদের সততা, নিষ্ঠা ও আনুগত্যবোধের প্রতিকূলে কোন সময়ে কোন গণঅনুযোগ বা আনুষ্ঠানিক বিভাগীয় অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। তখনকার পাকা সড়কবিহীন হেঁটে চলার পথ ধরে বন-জঙ্গল, নদী-নালা, খাল-বিল পার হয়ে একটি বল্লমসদৃশ লাঠির আগায় লণ্ঠন বেঁধে সরকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যবোধ নিয়ে এই রানাররা তাদের নির্দিষ্ট পথ ধরে যুগের পর যুগ ‘রান’ করেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সকল গ্রামের সকল গৃহে নিশ্চিন্তভাবে চিঠি আনা-নেয়া করেছেন এই রানাররা। তখনকার খুবই সীমিত পরিসরের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অপারগতার কারণে শহর থেকে সেখানে কর্মরত চাকুরে ও ব্যবসায়ীর অর্জিত আয়ের অংশ গ্রামে তাদের প্রিয়জনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তারা। তেমনি সম্পন্ন কৃষকের শহরে পড়ুয়া ছেলেমেয়ের কাছে মাসিক খরচাদির টাকা গ্রাম থেকে শহরে পৌঁছে গেছে তাদের পিঠে বওয়া মানিঅর্ডারের মাধ্যমে। তখনকার অনুন্নত অবকাঠামো সত্ত্বেও ডাক বিভাগের যোগাযোগের ও আদান-প্রদানের এই ধরনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ও কর্মপরিধি পৃথিবীর অন্য কোন দেশে বিস্তৃত হয়েছিল কিনা, আমার জানা নেই। উদাহরণত, বিত্তের উঁচু সমাহার সত্ত্বেও সৌদি আরবে এখন পর্যন্ত ঘরে ঘরে ডাক পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অতি সুলভে নিজের জীবনের স্বল্প বেতনভোগীর চিরন্তন অভাব-অনটন সত্ত্বেও এই ধরনের ত্যাগ ও নিষ্ঠার কাজ রানাররা যুগের পর যুগ করে গেছেন। সেই প্রেক্ষিতেই সুকান্ত তার রানার কবিতার মাঝখানে রানারের সময়ানুবর্তিতার দীক্ষা দিয়ে ঘেরা শ্রান্ত জীবনে প্রত্যাশিত স্বাধীনতা উৎসারণের প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসা করেছিলেনÑ ‘রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?’ সুকান্ত এই প্রশ্নের মাধ্যমে সরকারের এই দুস্থ, সৎ ও পরিশ্রমী কর্মচারীদের জীবন থেকে দুঃখের কাল নতুন যুগে, সম্ভবত স্বাধীনতার পর কেটে যাবে বলে আশা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এই সৎ ও পরিশ্রমী রানারদের চাকরির পারিতোষিকের বা সুযোগ-সুবিধার তেমন কোন তুলনামূলক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। সাধারণ মানুষের উৎপাদন ও আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জীবনের মৌলিক প্রয়োজনসমূহের লভ্যতাও বেড়েছে, কিন্তু অন্য শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের আপেক্ষিকতায় ওপরে উঠে যায়নি। ডাক বিভাগের চাকরির মই ধরে রানারদের উপর উঠে যাওয়ার কোন ঘটনাও দেখা যায়নি। ডাক বিভাগের কাঠামোয় তার অবকাশও সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে দেশের ডাক বিভাগে অনুমোদিত রানার পদের সংখ্যা ১৫৪৯টি। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডাক বিভাগ স্থানীয় পর্যায়ে রানার পদবির লোকবল নিয়োগ করত। সরকারের কর্মচারীদের শ্রেণী বিভাগের হিসেবে রানার পদটি চতুর্থ শ্রেণী বা নিম্নতম পদের। দেশে রেল, বিমান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃতি ও আধুনিকায়ন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসারণের ফলে আগের দিনের রানারের কাজের পরিধি ও প্রয়োজন উভয়ই কমে গেছে। সুকান্ত যে, ‘রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে’-এর কথা বলেছেন, তা এখন রানারের পদক্রমার বিশেষণ হিসেবে প্রায় হারিয়ে গেছে। এই প্রেক্ষিতে ২০০০ সাল থেকে রানার পদে নিযুক্তি বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে যারা রানার হিসেবে সরকারের নিয়মমতো অবসরে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন, তাদের বিপরীতে কোন রানার নিযুক্তি দেয়া হয়নি। বরং রানারের অনুমোদিত পদসংখ্যা অনুযায়ী (রানারের) খালি পদে একই বেতন স্কেলে ক্রমান্বয়ে ডাকপিয়ন, ডাক পরীক্ষক ও স্ট্যাম্প ভেন্ডার নিযুক্তি দেয়া হয়েছে। রানারের এসব পদের বিপরীতে রানার পদ বহির্ভূত নিয়োগপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা এখন প্রায় ৪০০। এর অর্থ, বর্তমানে রানার পদে ১১৫৯ জন নিয়োজিত আছেন। ডাক বিভাগ বলছে, মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে নতুন করে খালি হওয়া রানার পদের বিপরীতে এখন থেকে ডাকপিয়ন, ডাক পরীক্ষক, স্ট্যাম্প ভেন্ডার নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। অবশ্য এসব পদের বিপরীতে ভিন্নতর পদবির লোকবল সংশ্লিষ্ট কর্মবৃত্তে প্রয়োজন কিনা তা এখনও দরিয়াফত করে দেখা হয়নি। সাম্প্রতিককালে ডাক বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। সুকান্ত বলেছিলেন রোমান্টিকতার বাতাবরণে : ‘কত চিঠি লেখে লোকে- কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।’ এখন সেই পিঠে বওয়া বা হাতে দেয়া চিঠির বিকল্পে এসেছে ই-মেইল এবং নিপুণতর বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিস। টাকা প্রেরণের জন্য কাজে লেগেছে অনলাইন ব্যাংকের সেবা। আগেকার ডাকঘরের মাধ্যমে প্রেরিত মোর্স কোডভিত্তিক টেলিগ্রাম উঠে গেছে। টেলিফোন ও মোবাইল ফোনের বিস্তৃতির ভিত্তিতে জনগণ ট্রাংকল করার জন্য এখন আর ডাকঘরে যান না। সেখানে ভিড় করার প্রশ্নই ওঠে না। ষোলো কোটি লোকের দেশে এখন এসে গেছে ১২ কোটি মুঠোফোন। ফেসবুক, ফেসটাইম, স্কাইপ, ভাইবার, ওয়াটস্আপ ইত্যাদি বিস্তৃতির ফলে অধিকতর বস্তুনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য অবয়বে সেই সুখ, প্রেম, আবেগ, দুঃখ ও শোকের মাধ্যম হিসেবে ডাকঘরের ভূমিকা তরুণদের মধ্যে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বিদেশে ডাক ও পার্সেল নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে পাঠানোর জন্য ডাক বিভাগের বিকল্প হিসেবে এ দেশেও এসে গেছে ফেডেক্সস ও ইউপিস। কেবলমাত্র বয়োবৃদ্ধরা তাদের পুরনো দিনের স্মৃতি মন্থন করে আবেগ, দুঃখ ও শোক জানানোর মাধ্যম হিসেবে ডাকঘর, পিয়ন বা রানারের কথা এখনও বলে থাকেন। প্রথাগত ডাক মাধ্যমের বাইরে এখনকার ডাকঘর ডাক সঞ্চয় ব্যাংক, বীমাকরণ ও পরিশোধনের মাধ্যম এবং সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড বিক্রি ও নগদায়নের নিলয় হিসেবে কাজ করছে। এ ধরনের বিকল্পায়নের বিস্তৃতি আগেকার ডাক বিভাগের বৈশিষ্ট্য ও বৈভব রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে ডাক বিভাগ প্রথাগত ডাকসেবা অনেকাংশে বিকল্পায়িত করে ডাক মাধ্যমকে নতুনতর ও নিপুণতর সংযোগ ও বাণিজ্যিক বিপণনের মাধ্যম হিসেবে উন্নীত করে চলছে। সিঙ্গাপুরের ডাক বিভাগের প্রধান সম্প্রতি বলেছেন, বাণিজ্যিক বিপণনের নিপুণ মাধ্যম হিসেবে ডাক ব্যবস্থাকে উন্নীত না করতে পারলে ডাক বিভাগের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে সিঙ্গাপুরের ডাক বিভাগ এখন মূলত বাণিজ্যিক বিপণনের মাধ্যম হিসেবে বিবর্তিত ও প্রযুক্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি খাতে কর্মরত বিখ্যাত আমাজন কোম্পানির ডাক বিপণন ব্যবস্থার কথা স্মর্তব্য। বংলাদেশেও আমাদের ডাক ব্যবস্থাকে সেভাবে পরিবর্তিত ও উন্নীত করতে হবে। এই নিশানা অনুযায়ী ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন ও বিবর্তনের পটে কেবলমাত্র রানারই নয়, ডাক পিয়ন ও সমপর্যায়ের পদগুলো বিবর্তিত, স্বল্প-সংখ্যায়িত কিংবা বিকল্পায়িত হয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯৮৮৬টি ডাকঘর আছে। এর মধ্যে যমুনা নদীর ভাঙ্গনে গত বছর ৬টি ডাকঘরের স্থাপনা বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে সেগুলো পার্শ¦বর্তী গ্রাম/এলাকায় সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত ও কর্মরত আছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে আমাদের ডাক বিভাগে সর্বমোট লোকবল হলো ১৩,৯০২ জন। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেণীর (রানার ও ডাকপিয়নসহ) কর্মচারীর সংখ্যা ৩,৮৮৯, তৃতীয় শ্রেণীর লোকবল ৯,৮১৩ এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকবল ২৫ এবং প্রথম শ্রেণীর লোকবল ১৭৫ জন। স্পষ্টত চাকরির এই কাঠামোর পিরামিড অযৌক্তিক। কার্যকরণ সূত্র অনুযায়ী এর সংস্কার দরকার। বর্তমানে এই বিভাগের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের ১,৯২৭টি পদ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ৯৪৫টি পদ খালি রয়েছে। প্রয়োজনের নিরিখে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পদ খালি রাখা কতটুকু এ কাঠামোয় যুক্তিযুক্ত, তা বোঝা মুশকিল। ২০১৫-১৬ বছরের বাজেটে ডাক বিভাগের অনুকূলে ৫টি উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো যথাক্রমে (১) ডাক বিভাগের কার্যপ্রক্রিয়া সক্রিয় করা (২) জরাজীর্ণ ডাকঘরসমূহের নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ (৩) তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর নির্মাণ (৪) গ্রামাঞ্চলের জন্য ই-পোস্ট স্থাপন ও (৫) ডাক অধিদফতরের দফতর নির্মাণ। এদের মধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর ডাকঘর নির্মাণ ও গ্রামীণ এলাকার ডাকঘরে ই-সেন্টার স্থাপন বিষয়ক প্রকল্পের আওতায় ডাক ব্যবস্থাকে বিপণনের মাধ্যম হিসেবে রূপান্তরকরণের পরিধি এবং নতুনতর বাণিজ্যিক ও সেবাক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য বিস্তৃত করা যেতে পারে। বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর আওতায় এ ধরনের বিস্তৃতিকরণের কোন বস্তুনিষ্ঠ কার্যক্রম বা প্রস্তাব নেই। ২০১৫-১৮ সালে মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামোয় ডাক বিভাগের মিশন স্টেটমেন্ট এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে যুগোপযোগী পরিবর্তন বা উন্নয়নের সন্তোষজনক কার্যক্ষম প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলা চলে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে দিয়েছেন, তাতে ডাক বিভাগের দ্রুত ও ফলপ্রসূ অন্তর্ভুক্তি এখন যুগের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক ব্যবস্থার সেই রানার আর পিয়ন বাহিত বোঝা টানার দিন এভাবেই হয়ত শেষ হয়ে যাবে। আগের দিনের খবরের বোঝা দূরে সরিয়ে রানার এবং তার সহকর্মীদের যুগ বিবর্তনের আলোকে নতুনতর কার্যক্রম ও দায়িত্বের আলোকে সুকান্তের কথা মনে রাখতে হবে : ‘সময় হয়েছে নতুন খবর আনার’। এই নতুন খবরের প্রত্যাশায় সুকান্তের আহ্বানের অনুরণন করে ডাক বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নের বিস্তৃত পটে আমরা জনগণের তরফ হতে বলতে চাইÑ ‘শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ ভীরুতা পিছনে ফেলে- পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, অগ্রগতির মেলে।’ তাদের ও আমাদের সকলের অগ্রগতির মেল এই ক্ষণে এই সময়ে অববায়িত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে। প্রায় ৬ দশক আগে রহিম রানার সযতেœ কোন কাঁটা না ভেঙ্গে পুঁঁটি মাছ থেকে দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে সর্বাংশে যেমনি পুষ্টি ও তৃপ্তি গ্রহণ করতেন, মায়ের ¯েœহ ও মায়ার আবহে তেমনি আমাদের ডাক বিভাগের সব লোকবলকে প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বিত করে দেশের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যের আবরণে সর্বাত্মক উৎপাদনশীলতায় উন্নীত করতে ব্রতী রাখতে এই সময়ে এগিয়ে যেতে হবে। লেখক : রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী
×