ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাহেরুল স্যারের পাঠশালা

অবহেলিত শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ-বইখাতা ফ্রি

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২১ জুন ২০১৫

অবহেলিত শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ-বইখাতা ফ্রি

তৌহিদ আক্তার পান্না ॥ যেসব শিশুর লেখাপড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য নেই, বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাদের খুঁজে এনে বিনা পয়সায় লেখাপড়া করানো হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের শিক্ষা দিচ্ছেন ‘তাহেরুল স্যার’। কয়েক বছর ধরে তিনি চালিয়ে আসছেন এ কার্যক্রম। ৩৯ বছর ঈশ্বরদীর বিভিন্ন স্কুলে দায়িত্ব পালন করেন। পাঁচ বছর আগে অবসর নেন শিক্ষক তাহেরুল ইসলাম। চাকরি জীবনের ইতি টানলেও শিক্ষকতার নেশা ছাড়েনি তাঁর। অবসর জীবন শুয়ে-বসে সময় না কাটিয়ে পাড়ায় পাড়ায় খুঁজে বেড়ান হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের। যেসব শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাদের নিয়ে তাহেরুল স্যার বিনা পয়সার পাঠশালা গড়ে তোলেন। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিনি প্রায় চার বছর আগে ঈশ্বরদী পাকশী ইপিজেড রোড সংলগ্ন পাইলট লাইনে পাতিবিল এলাকায় একটি গাছের নিচে গড়ে তোলেন ‘বিনা পয়সার পাঠশালা’। যেখানে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করে এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করছে। পাবনার ঈশ্বরদীর সাঁড়া গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা তাহেরুল ইসলাম যাদের লেখাপড়া করান, তারা স্কুলে ভর্তি তো দূরের কথা, বাড়িতেও লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। শিক্ষক তাহেরুল নিজের পেনশনের টাকা ব্যয় করে তাদের বইখাতা-কলম কিনে দেয়া, লেখাপড়া শেখানো এবং স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পাঁচ মেয়ে সন্তানের জনক। একজনের মৃত্যু হয়েছে, চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ থাকেন না। প্রথমে বাড়ির ছাদে ওই শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। তাহেরুল ইসলাম জানান, প্রথমে গ্রামের কোন বাড়ির শিশুরা স্কুলে যায় না কিংবা কোন বাড়ির শিশুরা লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাদের বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। এতে খুব একটা লাভ হয়নি। ফলে তিনি সেসব শিশুদের দু’একটি বই যোগাড় করে দিয়ে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। এ কারণে তিনি ওইসব শিশুকে নিজবাড়িতে ডেকে এনে দুবেলা পড়ানো শুরু করেন। একই সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিশুদের জন্য পুরনো বই যোগাড় করতে শুরু করেন। বই যোগাড়ের পর শুরু হয় স্কুলের আদলে নিয়মমাফিক লেখাপড়া শেখানোর কার্যক্রম। পরবর্তী সময়ে পেনশনের টাকায় সবার জন্য বইখাতা, পেন্সিল কিনে বাড়িতেই ক্লাস নেয়া শুরু করেন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শেষে পর্যায়ক্রমে এদের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি। যাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন নিম্ন-মাধ্যমিক স্কুলে পড়ালেখা করছে। প্রতিদিন এসব শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়ার আগে তাহেরুল স্যারের কাছে ক্লাস করে যায়, আবার স্কুল থেকে এসে বিকেলে তার কাছে স্কুলের পড়া তৈরি করে বাড়িতে যায়। এই শিশুদের কারও বই ছিঁড়ে গেলে তাহেরুল ইসলাম নিজেই ছেঁড়া বই সেলাই করে দেন, আবার সাইকেল চালিয়ে শহরের কোন বাঁধাই ঘরে গিয়ে নিজের টাকায় বইটি বাঁধাই করে আনেন। এভাবেই চলছে তাহেরুল স্যারের বিনা পয়সার পাঠশালা। তাহেরুল স্যার দিনে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে দেখেন তার শিক্ষা দেয়া অবহেলিত শিশুরা স্কুলে ঠিকমতো উপস্থিত হচ্ছে কি-না, স্কুলে পড়ালেখায় ফাঁকি দিচ্ছে কি-না। তাহেরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালে সাঁড়া গোপালপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল রূপপুর সরকারী বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যখন অবসর গ্রহণ করি তখন বুক ভেঙ্গে কান্না এসেছিল! ভেবেছিলাম, কীভাবে অবসর জীবন কাটাব! এখন এই শিশুদের পড়ালেখা করাতে গিয়ে মনে হয় আরও আগে অবসর নিলেই ভাল হতো। তাহেরুল ইসলামের স্ত্রী তাহেরা খাতুন নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি জানান, তাদের কোন ছেলে নেই। মেয়েরাও সবাই শ্বশুরবাড়িতে। তাই এসব অবহেলিত শিশু যখন পড়াশোনার পাশাপাশি দুষ্টুমি করে, তখন দেখে মনে হয়, এরা আমাদেরই সন্তান। স্বামীর এই মহতী উদ্যোগকে তিনি সব সময় শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতা করেন। বিশেষ করে এসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে মাঝেমধ্যে বাড়িতে ডেকে খাওয়ানো, বাড়ির বিভিন্ন গাছের ফলমূল খাওয়ানো, ঈদের সময় নতুন কাপড় কিনে দেয়া ইত্যাদি কাজ করতে পেরে অনেক আনন্দ পান তিনি। ছাত্রী সুমাইয়া জানায়, তার বাবা সকিম উদ্দিন বেবিট্যাক্সি চালক। মেয়ে হওয়ায় তার বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করেননি। তাহেরুল স্যার এটি জানতে পেরে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এখন সে পড়ালেখা করতে পেরে খুব খুশি। একইভাবে সাঁড়া গোপালপুর পাতিবিল এলাকার রেলের জমিতে বসবাসকারী রওশন আরার ছেলে সাঁড়া গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র রুবেল জানায়, তার বাবা আবদুল আজিজ দীর্ঘদিন ধরে জেলখানায় অন্তরীণ থাকায় অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে তার মা তাকে স্কুলে পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাহেরুল স্যার তাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। একই স্কুলের ছাত্র হৃদয় হোসেন জানায়, তার বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। স্কুলে না গিয়ে বাবার সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করত সে। এখন তাহেরুল স্যারের উদ্যোগে সে স্কুলে যেতে পেরে আনন্দিত। রিকশাচালক আকরামের মেয়ে পাখি সাঁড়া গোপালপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। পাখির বাবা আকরাম হোসেন জানান, মেয়েকে যে স্কুলে ভর্তি করতে হবে সে বিষয়ে তার মাথায় কাজ করেনি। তাহেরুল স্যারের উদ্যোগে তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে পেরেছেন। এলাকাবাসী জানায়, তাহেরুল স্যারের কাছে যেসব শিশু শিক্ষাগ্রহণ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে, তারা প্রত্যেকেই ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে অসহায় শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখেন তাহেরুল স্যার।
×