ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মাসে ৯ জন নিহত ॥ দেশটির সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ

দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশীরা নিরাপত্তাহীনতায়

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২০ জুন ২০১৫

দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশীরা নিরাপত্তাহীনতায়

তৌহিদুর রহমান ॥ একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতিমাসেই দেশটির বিভিন্ন স্থানে কোন না কোন বাংলাদেশী নিহত হচ্ছেন। সেখানকার বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা প্রদানে দেশটির সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদনের পরেও এ বিষয়ে সাড়া মিলছে না। গত দু’মাসে দেশটিতে নিহত হয়েছেন ৯ জন বাংলাদেশী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বন্ধের পর বেশ কয়েক বছর ধরে অনেক বাংলাদেশী দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে ঝুঁকেছেন। দেশটিতে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশী নাগরিক রয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসব বাংলাদেশী ছোট ছোট দোকানপাট গড়ে তুলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলাদেশীরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে বাংলাদেশী শ্রমিক খুবই কম। দেশটির বিভিন্ন স্থানে দোকানপাট গড়ে তুলে ব্যবসা করছেন বাংলাদেশীরা। তবে গত কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। এই হামলার ঘটনার পেছনে কারণ দুটি। প্রথমত অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন। দ্বিতীয়ত চাঁদা না দেয়ার কারণে সন্ত্রাসী হামলা। সূত্র জানায়, গত এপ্রিল মাস থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসীদের ওপর হামলা চালানো শুরু হয়। বিদেশীরা এসে স্থানীয়দের চাকরি দখল করছে, এমন ক্ষোভ থেকেই সেই অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। আর সেই আন্দোলন থেকেই একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সে সময় হামলায় নিহত হন চার বাংলাদেশী। একই সঙ্গে বিদেশীদের পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানপাট লুট হয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অভিবাসীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করছে। সেসব দেশের নাগরিকরা দেশটিতে গিয়ে চাকরির বাজার দখল করছে বলে দক্ষিণ আফ্রিকানদের অভিযোগ। আর সে কারণেই সেসব বিদেশীর ওপর দক্ষিণ আফ্রিকানদের আক্রোশ রয়েছে। এই আক্রোশ থেকেই অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন শুরু করে তারা। এক পর্যায়ে আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। সেখানে সকল বিদেশীর ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। বিদেশী মালিকানার অনেক দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট চলতে থাকে। এখনও সেসব ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। জানা গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় মূলত জিম্বাবুইয়ে থেকে অভিবাসী বাড়ছে। জিম্বাবুই যে থেকে দেশটিতে কয়েক লাখ অভিবাসী অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করছে আন্দোলনকারীরা। তাদের বিরুদ্ধেই মূলত সেই আন্দোলন। তবে সেই আন্দোলনে রেহাই পাচ্ছেন না সেখানকার অন্যান্য দেশের অভিবাসীরাও। আর এই অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশীরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত বাংলাদেশী নাগরিকদের সাবধানে থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে একাধিকবার আবেদনের পরেও দেশটির সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা যায়। এদিকে অভিবাসী বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি দেশটিতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। বাংলাদেশীদের বিভিন্ন দোকানপাটে গিয়ে সন্ত্রাসীরা চাঁদা দাবি করছে। আর চাঁদা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে হামলা চালানো হচ্ছে। হামলার পাশাপাশি হত্যাও করছে দুর্বৃত্তরা। মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় জিম্বাবুইয়ের সীমান্তবর্তী শহর মাসিমায় নিহত হন ফারুক স্বপন। সেখানে একদল চাঁদাবাজ স্বপনের দোকানে এসে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দেয়ার পরেও দুর্বৃত্তরা স্বপনকে গুলি করে হত্যা করে। আবার যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা দোকানের অর্থ ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম, ফেনীর দাগনভূঞার দিদারুল আলম, জামালপুরের লুৎফর রহমান, কুমিল্লার জম্মান আলীকেও এভাবে হত্যা করে সেখানকার স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে হামলার কারণে বিভিন্ন সময় আহতও হচ্ছেন বাংলাদেশীরা। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন দুই বাংলাদেশী সহোদর। সেই হামলায় নিহত হন ইব্রাহিম। অপর সহোদর ইসমাইল গুরুতর আহত হন। দেশটির রাজধানী প্রিটোরিয়ার সোসাংগবি এলাকায় তাদের দোকানে হামলা চালায় স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তারা দোকানে গিয়ে দুই ভাইয়ের হাত-পা বেঁধে বেদম মারধর করে। এছাড়া টাকা পয়সা ও মালামাল লুটপাট করেও নিয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা তাদের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় দুই ভাই অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে ভর্তির পরে মারা যায় ইব্রাহিম। উল্লেখ্য, গত বছর আগস্ট মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার অনাবাসী হাইকমিশনার জিওফ্রে কুইনটন ডয়েজ ঢাকা সফরে আসেন। সেসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে তিনি সেখানকার বাংলাদেশীদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও দেন।
×