ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের নতুন বিস্ময় মুস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২০ জুন ২০১৫

বাংলাদেশের নতুন বিস্ময় মুস্তাফিজ

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ চমকে ভরা পৃথিবীতে বিস্ময়কর অনেক কিছুই ঘটে। চোখের অন্তরালে থেকে যায় সব। তবে অনেক ঘটনাই আছে যা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়ে হতভম্ব হয়ে যান অনেকেই। মুস্তাফিজুর রহমান নামটা এখন বাংলাদেশের মানুষের বুকে গেঁথে গেছে। সেজন্য তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা লেগেছে। শুধু দেশবাসী নয়, অবিশ্বাস্য এক চমক উপহার দিয়েছেন তিনি পুরো বিশ্বকেই। সফরকারী ভারতের বিরুদ্ধে বহুল আকাক্সিক্ষত বিজয়টা এসেছে এই ১৯ বছরের তরুণের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সুবাদেই। তরুণ পেসার মুস্তাফিজ ওয়ানডে অভিষেকেই ৫০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে একাই হারিয়ে দিলেন ভারতীয় দলকে। তাই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার কণ্ঠে তার জন্য ঝরলো দারুণ প্রশংসা। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ভারতকে হারিয়ে আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবার সাত নম্বরে উঠলো বাংলাদেশ দল। তবে আসন্ন সেপ্টেম্বরের মধ্যে র‌্যাঙ্কিং অন্তত আট রাখতে না পারলে আগামী চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলার সুযোগ পাবে না দল। সেজন্য অন্তত আরেকটি ওয়ানডে জিততে হবে। এ বিষয়টি বেশ ভালভাবেই জানা আছে মাশরাফির। এ কারণে তিনি এখন পরবর্তী ওয়ানডে নিয়েও চিন্তা করছেন এখন থেকেই। বর্তমান প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ অতীতে অনেকবার চ্যালেঞ্জিং কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দল গড়ার ক্ষেত্রে। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র টি২০ ম্যাচের দল ঘোষণার সময় তেমনই এক অবাক করে দেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুস্তাফিজ নামটা ঘোষিত ১৪ সদস্যের দলে দেখে অনেকেই ফিসফিস করছিলেন, ‘কে এই মুস্তাফিজ?’ একই প্রশ্ন বছর দেড়েকের কিছু বেশি সময় আগে উদয় হয়েছিল ফারুকেরও মনে। কারণ দেশের ক্রিকেট কারিগর যারা, যারা ক্রিকেট বোদ্ধা তারাও মুস্তাফিজকে তখন পর্যন্ত চিনতেন না। না চেনারই কথা। কারণ ২০১৩ সালে সাতক্ষীরা থেকে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে পেস বোলিংয়ে নিজের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। সেখানে বাছাই হয়ে অনুর্ধ-১৭ দলের হয়ে খেলেছেন। দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছেন অনুর্ধ-১৯ দলে। এবার তিনি খেলেছেন জাতীয় লীগ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগেও। ততোদিনে মুস্তাফিজকে ফারুকসহ দেশের ক্রিকেটের মাথারা চিনে ফেলেছেন এবং তার ওপর আস্থা খুঁজে পেতেও শুরু করেছেন। এ কারণেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি২০ ম্যাচে অভিষেক ঘটলো মুস্তাফিজের। আর সেই ম্যাচেই তিনি শহীদ আফ্রিদির মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ক্রিকেটারের উইকেটসহ দুটি উইকেট শিকার করলেন তখন থেকেই এ দেশের ক্রিকেট আবেগী মানুষ তাকে অন্তরে ঠাঁই দিলেন। যদিও সাকিব-তামিম-মুশফিক যুগে পুরোপুরি হৃদয় কাড়তে পারেননি এক ম্যাচ খেলে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সবার বুকের ধন, হৃদয়ের অংশ হয়ে গেছেন একাই দুরন্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে বাংলাদেশ দলকে জিতিয়ে। দুই বছর আগে নিজ জেলা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের মানুষ ছাড়া আর কেউ চিনতেন না তাকে। কিন্তু ধূমকেতুর মতো উদয় ঘটলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। গত এপ্রিল থেকে দেশের ক্রিকেট ভক্তরা একটু করে তাকে চিনতে শুরু করেছিলেন। তবে এখন তাকে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার রোমাঞ্চকর ব্যাট-বলের লড়াইয়ের পর থেকে সারাবিশ্ব চিনে ফেলেছে। প্রথম ওয়ানডেতে ভারতীয় দল যতটা সময় ব্যাটিং করেছে পুরোটা সময়ই মুস্তাফিজ আতঙ্কে ভুগেছে। রোহিত শর্মা ও আজিঙ্কা রাহানেকে সাজঘরে ফিরিয়ে দেয়ার পর তার চোখেই নিজেদের চরম সর্বনাশ দেখতে পেয়েছিলেন যেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ইচ্ছাকৃতভাবে কনুইয়ের গুঁতোয় আহত করেছিলেন মুস্তাফিজকে। তবে ফিরে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে তছনছ করে দিলেন বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ। সত্যিকার টাইগার ক্রিকেটার তিনি। উঠেও এসেছেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবনের খুব কাছের এলাকা থেকে। গর্জনে কাঁপিয়ে তুললেন ভারতীয় দলকে। মুস্তাফিজের প্রশংসা করে তাই মাশরাফি বলেন, ‘আরাফাত সানি খুব ভাল বোলিং করছিল। ওকে বাদ দেয়া কঠিন ছিল। কিন্তু আমরা মনে করেছিলাম মুস্তাফিজকে খেলানো দরকার। অনুশীলনে ওকে যেমন দেখেছি, তাতে উপেক্ষা করা কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত সাহস করে আমরা ওকে নিয়েছি। ফলও পেয়েছি। আসলেই ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ।’ মাশরাফি ওয়ানডে নেতৃত্বে ফেরার পর থেকেই অনেক পরিবর্তন এসেছে দলের সমন্বয়ে। শুরু থেকেই তিন পেসার নিয়ে একাদশ গড়েছেন তিনি। এবার সেটাকেও ছাড়িয়ে চার পেসার নিয়ে খেললেন। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আমি অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে নিয়মিত তিন পেসার খেলাচ্ছি। কারণ আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি, ম্যাচ জেতায় বোলাররা। আমি, রুবেল আর তাসকিন তো আগে থেকেই ছিলাম। আর মুস্তাফিজ যে ধরনের বল করে, আমার কাছে মনে হয়েছে, এই উইকেটে ওকে খেলা কঠিন হবে।’ সেøায়ার ডেলিভারিগুলো খুব মারাত্মক ছিল মুস্তাফিজের। রাহানে ও রোহিতকে সেøায়ার দিয়েই পরাস্ত করেছেন। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘মুস্তাফিজের সেøায়ার বলে মুগ্ধ হয়েই তাকে দলে রাখা হয়েছিল। মুস্তাফিজকে আমরা অনেক আগেই টার্গেট করেছিলাম। ওর যে কাটার আছে, কোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই খেলা সহজ নয়। ওর ওই বল স্পিনারের চেয়েও বেশি টার্ন করে।’ বাঁহাতি পেসারদের সহজাত কোনাকুনি বলটা এমন দারুণ জায়গায় ফেলেন যে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা তাতে হাবুডুবু খেতে বাধ্য। এর সঙ্গে আঁততায়ী এক কাটার, কালকের ম্যাচের পর যে কাটার এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার অংশ। ৫টি উইকেটই কাটারে। এর মধ্যে পরপর দুই বলে রায়না ও অশ্বিনকে আউট করে সম্ভাবনা জাগালেন হ্যাটট্রিকেরও। এক বছর এক দিন আগে এই মিরপুরে এই ভারতের বিপক্ষেই অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। তাসকিনের সেই আনন্দ পূর্ণতা পায়নি দল হেরে গিয়েছিল বলে। কাল মুস্তাফিজুরের সেই দুঃখও থাকল না। দেশের ক্রিকেট আবেগী মানুষ এবার শুরু থেকেই বলছিলেনÑ ‘প্রতিশোধ নেব বিশ্বকাপ পরাজয়ের।’ সেটাও পেয়ে গেল দেশবাসী। অথচ হারের আগেই হেরে বসাটা বছর দুয়েক আগেও ছিল বাংলাদেশ দলের নিত্যসঙ্গী। এবার প্রতিপক্ষকেই সেই পরিস্থিতিতে ফেলে আগেভাগেই যেন জিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিশ্চিত করার পালা। সেজন্য জিততে হবে আরেকটি ম্যাচ। কারণ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে অন্তত আটে থাকতে না পারলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলা হবে না বাংলাদেশের। সেই লক্ষ্য এখন মাশরাফির। আরেকটি ম্যাচ জয়। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘প্রতিশোধ নিয়ে কিছু ভাবিনি। ক্রিকেটে এসব নিয়ে ভেবে স্বাভাবিক খেলাটা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলা নিয়ে ভাবতে চাই। যতদূর জানি সেটা এখনও নিশ্চিত হয়নি। আরেকটি ম্যাচ জিততে হবে। সেজন্য আমরা প্রতিটি ম্যাচ নিয়ে আলাদা করে ভাবছি।’
×