ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন ৩ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত তৈরি সম্ভব

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২০ জুন ২০১৫

বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন  ৩ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত তৈরি সম্ভব

রশিদ মামুন ॥ ইতালিয়ান কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের সঙ্গে বিগত ২০১৩ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি আলোচিত চুক্তি হয় । ঢাকার বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করার কথা ছিল কোম্পানিটির। পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনাও ছিল। ঢাকার মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচত এই ভেবে যে, হয়ত চলতিপথে আর ময়লার ভাগাড় তাদের দেখতে হবে না। থুথু ফেলে বিরক্তিভরে নাকে রুমাল চাপা দিতে হবে না। পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে প্রিয় নগরী ঢাকা। বর্জ্য পরিণত হবে সম্পদে। কিন্তু আলোচিত সেই চুক্তি আর বাস্তবে রূপ পেল কোথায়। ঢাকা যেমন ছিল তেমনই আছে। এভাবে ঢাকার বর্জ্যে আশা জাগানো প্রকল্পের কথা শোনা গেছে বার বার। কখনও স্বপ্নও দেখিয়েছে। তবে সেই প্রত্যাশা কবে বাস্তব হয়ে ধরা দেবে তা জানা নেই কারও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বর্জ্য দিয়ে দৈনিক অন্তত ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। ঢাকার বর্জ্যে আলোচিত সেই বিদ্যুত প্রকল্পটি কেন হারিয়ে গেল এমন প্রশ্নে সে সময়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম শহীদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ইতালিয়ান কোম্পানিটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। তাই প্রকল্পটি আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকার বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব জানিয়ে শহীদ খান বলেন, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন বেশ কঠিন কাজ। কেউ সাহস করে কাজ করতে চায় না। আমি তা চেয়েছিলাম। কিন্তু কোম্পানিটির ব্যর্থতার কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের বর্জ্যরে মান ভাল নয়, তবে সেটা কোন সমস্যা নয়। যারা বিদ্যুত উৎপাদন করবে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বাছাই করে নেবে। আর সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে (পিপিপি) এখনও এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। বর্জ্য থেকে ফার্মেন্টেশন বা গাজন প্রক্রিয়ায় বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। বর্জ্যেের সেলুলোজ এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ থেকে ইথানল তৈরি হয়। তবে বর্জের মধ্যে চিনি বা চিনিজাতীয় পদার্থ থাকলে তা থেকে তৈরি হয় কার্বন-ডাই অক্সাইড এবং এ্যালকোহল। একই প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে পারে বায়ো-ডিজেলও। পরে পাইরোলাইসিস বা তাপীয় বিয়োজনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় মিথেন বা ইথেন গ্যাস। এই গ্যাসকেই বিদ্যুত উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। সাধারণ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের মতোই বর্জ্য থেকে বিদ্যুত হতে পারে। এতে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি একেবারে নেই। অর্থাৎ বর্জ্য পরিবেশে যে দূষণ ছড়ায় বিদ্যুত উৎপাদন পক্রিয়ায় তা ব্যবহার করা হলে চারপাশের পরিবেশ আরও নির্মল এবং বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। শুধু বিদ্যুতই নয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিসিসির মাতুয়াইল ও আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের স্তূপাকার বর্জ্য থেকে পাইপ বসিয়ে গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া গ্যাস উৎপাদনের পর কমপোস্ট সার তৈরি করা যাবে। ইতোমধ্যে সীমিত পরিসরে এই জৈবসার তৈরি শুরুও হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে এক ধরেনর জ্বালানি তেল তৈরি হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে গাড়ির ব্যবহৃত পুরাতন অকেজ টায়ার পুড়িয়ে জ্বালানি তেল তৈরি হচ্ছে দেশে; যা দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনও সম্ভব। এর বাইরেও লোহা, কাঁচ, কাগজ, পলিথিন সবকিছু রিসাইকেল করা সম্ভব। কিন্তু দুর্গাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজধানী ঢাকাসহ আমাদের কোন মহানগরীতেই বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা এতকালেও গড়ে ওঠেনি। বাসাবাড়ির সব বর্জ্যই জমা করা হয় রাস্তার ধারে। নগর কর্পোরেশন সেই বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়ে ডাম্পিং করে। মানব বর্জ্যরে পুরোটাই ছেড়ে দেয়া হয় নদীতে। বছরের পর বছর ধরে কেবলমাত্র উদ্যোগের অভাবে সরকার নিজেই বিষিয়ে তুলছে শহুরে জীবনকে। আধুনিক ঢাকা গড়ার দায়িত্ব নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর ঢাকা পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণের দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ঢাকার মানব বর্জ্যর পরিবাহন ড্রেনেজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ আবার ঢাকা ওয়াসার কাছে। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যুগোপযোগী করে তুলতে এই তিন সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু রাজউক, সিটি কর্পোরেশন কিংবা ওয়াসা কারও মধ্যে তেমন কোন সমন্বয় কোনদিন চোখেই পড়েনি নগরবাসীর। স্থানীয় সরকার বিভাগের এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে বিদ্যুত বিভাগকেও কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কেবলমাত্র কেউ তৈরি করে দিলে আমরা কিনব এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে নবায়নযোগ্য এই জ্বালানি সম্পদকে কাজে লাগানো উচিত বলে বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন। ঢাকার দুই নগর অফিসের হিসেব বলছে দেড় কোটির বেশি মানুষের এই ঢাকাতেই প্রতিদিন অন্তত আট হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে আরও এক হাজার ৫০০ টন বর্জ্য যোগ হয়। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে আছে প্লাস্টিক, কাগজ, কাঁচ, ধাতু এবং জৈব বর্জ্য। অন্যদিকে ঢাকার পরেই একই এলাকায় বেশিসংখ্যক মানুষের বাস চট্টগ্রামে। বন্দরনগরীতে একসঙ্গে বসবাস করছেন ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ। এখানে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টন বর্জ্য। কেবলমাত্র এই দুই মহানগরীতে প্রায় ১২ হাজার টন বর্জ্যরে মধ্যে বেশিরভাই রান্নার উচ্ছিষ্ট পচনশীল; যা মিথেন উৎপাদন করতে সক্ষম। হিসেব বলছে, এই বর্জ্যরে পরিমাণ মোট বর্জ্যরে ৬০ শতাংশ। প্রতি এক মেগাওয়াট বিদ্যুত প্লান্ট চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ৪০ টন বর্জ্য। এই হিসেবে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বর্জ্য দিয়ে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। এর বাইরে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরের বর্জ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। আলোচিত সেই চুক্তির দিকে তাকালে দেখা যায় ঢাকা শহরে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত ইতালির ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০ বছর। প্রকল্পটিতে ইতালিয়ান কোম্পানিটি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলেছিল। দুই সিটি কর্পোরেশনকে কোম্পানিটি বছরে ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দেবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। আর প্রতি ৫ বছর পরপর লিজের টাকার পরিমাণ ২০ শতাংশ হারে বাড়ার কথাও ছিল। চুক্তি অনুযায়ী ঢাকার আমিনবাজার এবং মাতুয়াইলে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র করার কথা ছিল কোম্পানিটির। প্রাথমিকভাবে এই দুই কেন্দ্র থেকে ২৪ মেগাওয়াট করে মোট ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। পর্যায়ক্রমে যা বেড়ে ১০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা ছিল। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হলে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো বলে ধারণা করা হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, প্রকল্পটির বর্জ্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন জোগান দেবে আর তা দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করবে কোম্পানিটি। কথা ছিল সেই বিদ্যুত সরকার কিনে নেবে কিলোওয়াট প্রতি আট দশমিক ৭৫ টাকা দরে; যা দেশের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে কোম্পানিটিই বছরে সিটি কর্পোরেশনকে ৭০ লাখ টাকা দেবে। অন্যদিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করে নগরীর দুটি ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলে। একটি ইয়ার্ড রয়েছে হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায়, অন্যটি বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার আরেফিন নগরে। এই সিটি কর্পোরেশনেও ১৪টি বিদেশী কোম্পানি থেকে যাচাইবাছাই করে একটি রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও কিছু কর্মকর্তার সদিচ্ছার অভাবে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। জার্মানির কারিগরি সহায়তায় এবং বিনিয়োগে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি চালু হলে সিটি কর্পোরেশনের বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। অর্থাৎ ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেই বর্জ্যকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু হলেও তা হারিয়ে গেছে। সিটি কর্পোরেশন নতুন করে আর এই পথে হাঁটেওনি। রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস জামান চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রাথমিকভাবে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওই সময় ঢাকায় ইতালীয় কোম্পানির সঙ্গে আট টাকা ৭৫ পয়সা কিলোওয়াট দরে সরকার চুক্তি করেছিল আমরাও সেই দর দিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আমাদের অনুমোদন দিলেও স্থানীয় সরকার বিভাগে তা এখনও ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে আছে। তিনি বলেন, যেভাবে আমাদের দেশে বর্জ্য মাটিতে ডাম্পিং করা হয় সারা বিশ্বের সবখানে তা বাতিল করে দিয়েছে। এতে ভূগর্ভস্থ মাটি চুইয়ে পানিতে গিয়ে বর্জ্য মিশে বিষাক্ত করে পানিকে। দেরিতে হলেও বিদ্যুত বিভাগ বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করার উদ্যোগ নিয়েছে। এখন ইউএনডিপির সহায়তায় বিদ্যুত বিভাগ বর্জ্য বিদ্যুতের সম্ভাবনা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য শীঘ্রই পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে। ইউএনডিপি এবং বিদ্যুত বিভাগের যৌথ উদ্যোগে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোঃ মনোয়ার হাসান খান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা শীঘ্রই পরামর্শক নিয়োগ দেব। তিনি পাঁচ থেকে ছয় মাস সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। এর পর একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেয়া হবে।
×