ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের প্রিয় খালাম্মা কবি সুফিয়া কামাল

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২০ জুন ২০১৫

আমাদের প্রিয় খালাম্মা কবি সুফিয়া কামাল

সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক মহান ব্যক্তিত্ব। সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী, দায়িত্বশীল ভূমিকা দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাখা অনন্য অবদান আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। বিশ শতকে ব্রিটিশশাসিত কলকাতার সাহিত্য পত্রিকায় কবি হিসেবে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ। তখন মুসলমান নারীসমাজ রোকেয়ার জাগরণী মন্ত্রে সবেমাত্র দীক্ষা নিতে শুরু করেছে। সেই সময়ে সুফিয়া কামালের কবিতা সেকালের কবি, সাহিত্যিক ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁকে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন। বাবার স্নেহবঞ্চিত সুফিয়ার প্রথম শিক্ষা শুরু হয় মায়ের কাছে, মায়ের গভীর স্নেহছায়ায়। বরিশালের শায়েস্তাবাদের নানাবাড়ির আভিজাত্য তাঁকে কখনও সেভাবে আকর্ষণ করেনি, যতটা করেছে বাংলার আকাশ, বাতাস, সাগর-গিরি, নদ-নদী, ঘাস, ফুল, পাখি। প্রকৃতি শুধু তাঁকে পরিপুষ্ট করেনি, করেছে মানবিকও। তাঁর কাছে শুনেছি একবার তিনি কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে। তখন সেই বাড়িতে একদিন বেগম রোকেয়া বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি সুফিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে তাঁর মাকে বলেছিলেন, আমার স্কুলে আপনার মেয়েকে পড়তে দিন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, কারণ তাঁকে মায়ের সঙ্গে পুনরায় ফিরে আসতে হয়েছিল বরিশালের নানাবাড়িতে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় মামাত ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাহেবের কাছে শুনেছিÑ নেহাল হোসেন তাঁকে তখনকার নবাব পতৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি তাঁকে ক্রিকেটের মাঠেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর উৎসাহে তিনি উড়োজাহাজে চড়ে কলকাতা পরিক্রম করেন। আমাদের জননী সাহসিকা খালাম্মার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অদম্য উৎসাহ ছিল। কিন্তু তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ হয় বরিশালে। মামার বিশাল লাইব্রেরীই তাঁকে নিরন্তর প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছে। বই ও নানা ধরনের পত্রিকা পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো চেষ্টা করলে তিনিও একদিন লেখক হতে পারবেন। চারপাশের বন্ধুদের নিয়ে বকুল ফুলের মালা গেঁথে, দোলনায় দুলে, পাখির গান শুনে, নদীর বাতাসে শ্বাস নিয়ে লতায়-পাতায় জড়াজড়ি করে সেই সময়ের তাঁর মধুরতর দিনগুলো কেটেছে। তখন দেশজুড়ে স্বদেশী আন্দোলন চলছিল। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে লুকিয়ে একদিন তিনিও বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন। ভেতর থেকে অহর্নিশ তাগিদ অনুভব করতেন দেশের কথা, মানুষের কথা জানার। কলকাতায় থাকার সময় তাঁর প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ ও বিকাশ ঘটতে শুরু করে। মাসিক সওগাত ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। বিষয়, ছন্দ এবং প্রকৃতিগত সারল্য তাঁকে এক সময়ে কবি হিসেবে পরিপূর্ণ করে তোলে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন তাঁর মধ্যে আবিষ্কার করেন যথার্থ কবি প্রতিভা। শুধু কবিতা নয়, কবিতার সঙ্গে তাঁর ছবিও সওগাতে ছেপে দিয়ে সেই সময়ে মুসলমান সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন। কলকাতায় থাকতেই ১৯৩২ সালে অকস্মাৎ তাঁর স্বামীর মৃত্যু এবং কন্যাসন্তান নিয়ে বিধবা হন। সূচনা হয় জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। কলকাতা কর্পোরেশনের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১৭ টাকা বেতনে শিক্ষকতার চাকরি নেন। নিজেকে তৈরি করে নিলেন এই দায়িত্বের জন্য। প্রথম জীবনের সেই আঘাত এবং নিত্যদিনের সংগ্রাম, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা একটু একটু করে তৈরি করেছিল আমাদের প্রিয় খালাম্মা জননী সাহসিকাকে। তরুণ বয়সের অসহায়ত্ব তাঁকে মর্যাদাসম্পন্ন এবং অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে গড়ে তুলেছিল। ১৯৪০ সালে লেখক হিসেবে সুপরিচিত সরকারী চাকরিজীবী কামালউদ্দিন খান সাহেবের সঙ্গে তাঁর পুনর্বার বিয়ে হয়, শুরু হয় তার নতুন জীবন। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরস্থির, সৎ, দরদী এই মানুষটি আজীবন তাঁকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে সহায়ক ভূমিকা রেখে গেছেন। স্বামী-সন্তান, সংসার সামলিয়ে কাব্যচর্চা এবং সমাজ, সংস্কৃতি ও দেশের কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন তিনি। শুনেছি তাতেও উৎসাহ যুগিয়েছিলেন কামালউদ্দিন খান। কবির কাছেই শুনেছি, রাতের কাজকর্ম শেষ করে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে প্রতি রাতে তিনি লিখতে বসতেন। লেখার ভাবনাটা মাথায় গুছিয়ে নিয়ে তিনি লিখতে বসতেন বলেই তাঁর লেখা তর তর করে এগিয়ে যেত। এভাবেই তিনি বিশেষভাবে কবি ও গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। শৈশব থেকেই বই পড়ার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বইয়ের প্রতি সেই ভালবাসা অক্ষত ছিল। ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হলে তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কয়েক মাস তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কাব্যচর্চার পাশাপাশি ঘর থেকে বের হতেন দেশ ও মানুষের কল্যাণের কাজে। বর্ধমানে স্বামীর কর্মস্থলে থাকার সময় প্রথম তিনি খাদ্যের দাবিতে বের হওয়া এক মিছিলে অংশ নেন। কলকাতায় থাকার সময়ে দেশ বিভাগের পূর্বে ও পরে যে দাঙ্গা হয় সেই দাঙ্গায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৪৮ সালে সুফিয়া কামাল সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি গঠন, ১৯৫১ সালে শিশুরক্ষা ও ১৯৬৫ সালে নারী কল্যাণ সমিতি এবং ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী হিসেবে নারীর অধিকার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। ক্রমান্বয়ে পরিচিত হন তিনি বিশিষ্ট সমাজকর্মী আশালতা সেনের সঙ্গে এবং যুক্ত হন সদ্য গড়ে ওঠা গে-ারিয়া মহিলা সমিতির সঙ্গেও। সেই সময়ের আর একটি অনন্য কাজের খবর আমরা অনেকেই জানি না। তা হলো তাঁর রেডিও’র সঙ্গে যুক্ত হওয়া। খালাম্মা তখন রেডিও’র ‘মহিলা মহল’ নামের অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। ১৯৫৬ সালে তাঁর বাড়িতে মাদুর বিছিয়ে করা এক সভার মাধ্যমে গঠন করা হয় আজকের দেশের বৃহত্তম শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা। আজীবন তিনি এই সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন। সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এই একই সময়ে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন শামসুন্নাহার মাহমুদ, জোবেদা খাতুনসহ আরও অনেক বিশিষ্ট নারীর সঙ্গে ঢাকায় নারী শিক্ষার জন্য একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে। পাশাপাশি চলে নারীর পুনর্বাসন ও নারী অধিকার আদায় এবং প্রতিষ্ঠার কাজে। শামসুন্নাহার মাহমুদের সঙ্গে মতের ভিন্নতা থাকলেও তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনেও জননী সাহসিকা রাজপথে ছিলেন। ছাত্রদের ওপর গুলি, গ্রেফতারের খবর পেয়ে আয়োজিত মিছিল ও প্রতিবাদ সভায় অংশ নিয়ে সচেতন বাঙালীর স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। বাঙালীর সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়, নারী অধিকার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, সর্বোপরি রাজনৈতিক আন্দোলন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় বিবেক হিসেবে তিনি এক অসাধারণ মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সুদীর্ঘ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শতাব্দীর সাহসিকা হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আজ তিনি মর্যাদায়, শ্রদ্ধায় অভিষিক্ত। বাংলাদেশের নারীকে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার সারা জীবনের লড়াই তাঁকে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে যা তুলনাহীন। সুফিয়া কামাল মানুষ হিসেবে কত বড়, কত মহৎ ছিলেন তা তাঁর সাংসারিক প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হতো। বাড়ির কাজের লোকেরা অসুস্থ হলে শুধু ওষুধপত্রই নয়, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজহাতে সেবাযতœ করতেন। বেগম সম্পাদিকা নূরজাহান বেগমের কাছে শুনেছি গভীর শোকেও তিনি স্থির, নিশ্চল থাকতেন। ১৯৫৫ সালে খালাম্মার মেঝ ছেলে শোয়েব নিহত হওয়ার পর খালু কামালউদ্দিন খোঁজ নিয়ে এসে যখন তাঁকে জানালেন, ‘তোমার ছেলে শহীদ হয়েছে’, পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক নিশ্চল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই একই দৃশ্য আমি দেখেছিলাম খালু কামালউদ্দিন খানের মৃত্যুর পরও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বড় মেয়ের জামাই আবদুল কাহহার আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান, এ কষ্টও তিনি সহ্য করেছেন নির্বাক নিশ্চল হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় কাপড়, চাল, ওষুধ, সংগ্রহ করে লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাঁর বাসায় দিয়ে যেত। দুই মেয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কলকাতায় আর ঠিক সেই সময় অকুতোভয় এই মহীয়সী নারী তোপের মুখে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষে বিজয় লাভের পর বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত, শহীদ পরিবারের কল্যাণের জন্য নানা পদক্ষেপ এবং জাতীয় পুনর্গঠনসহ যুদ্ধাহত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য যথাসাধ্য ভূমিকা রাখতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর একটি সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না, তা হলোÑ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করার খবর পেয়ে মিসেস নার্গিস জাফরকে সঙ্গে নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গিফট কিনে তিনি মহা ভয়কে জয় করে তাঁদের দেখতে গিয়েছিলেন। সাংবাদিক, লেখক লায়লা সামাদের এক লেখায় আমি পড়েছিলাম চেকোশ্লোভাকিয়া যাওয়ার জন্য সেই সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে তাঁকে শুধু লালগালিচা সংবর্ধনাই দেয়া হয়নি, প্লেন থেকে না নামা পর্যন্ত কাউকে সেই প্লেন থেকে নামতে এবং তিনি প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত কাউকে সেই প্লেনে উঠতেও দেয়া হয়নি। রাশিয়ার যুদ্ধ জয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সম্মেলনে দুই বাংলার দুই বিশিষ্ট সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁদের একজন বাংলাদেশের কবি সুফিয়া কামাল এবং অন্যজন পশ্চিম বাংলার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কলকাতায় ১৪০০ সাল উপলক্ষে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় তিনি সমাজের জমাট অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যয়, প্রগতি ও সাহসিকতার দীপশিখা জ্বালিয়ে গেছেন জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল। কখনও মনে হয় এ আন্দোলন বুঝি ব্যক্তির অথবা একান্তই নারী কিংবা শিশুর অথবা কোন সম্প্রদায়ের। আসলে এ ছিল একান্তভাবেই আমাদের সকলের, সকল সম্প্রদায়ের, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের। লেখক : সাংবাদিক
×