ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়ানডেতে ভারত ৭৯ রানে পরাজিত ॥ সেই তো হারল

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১৯ জুন ২০১৫

ওয়ানডেতে ভারত ৭৯ রানে পরাজিত ॥ সেই তো হারল

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ কথায় আছে, ‘প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না।’ তাই বলে এত দ্রুত প্রকৃতির শাস্তি মিলে যাবে! তিন মাস না যেতেই ভারতকে ৭৯ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রতিশোধও নিয়ে নেবে বাংলাদেশ। এতদিন পর কেন, প্রকৃতি তো বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মাত্র ৬ বলের মধ্যেই আরেক শাস্তি দিয়ে দিল। ২৪.২ ওভারের সময় রান নিতে গিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনি ধাক্কা মেরে পেসার মুস্তাফিজুর রহমানকে আহত করলেন। বুকের ব্যথায় মাঠ ছাড়তে হলো মুস্তাফিজকে। ২৫.৩ ওভারেই ধোনি আউট হয়ে গেলেন! মুহূর্তেই প্রকৃতির শাস্তি মিলে গেল। ভারতের হার যেন সেখানেই লেখা হয়ে গেল। ততক্ষণে যে ৫ উইকেটের পতন হলো। ভারতের এ হারে শুধু প্রতিশোধই নিল না বাংলাদেশ, এটাও বুঝিয়ে দিল, যদি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষে না যেত, তাহলে ম্যাচের ফল অন্যরকমও হতে পারত। পুরো জাতি অপেক্ষায়। ২১৯ রানে ভারতের ৯ উইকেট পতনের পর থেকেই কখন যাবে আর একটি উইকেট, কখন যাবে; এই আশাই করা হয়েছে। যেই ২২৮ রানে সাকিবের বলে এলবিডব্লিউ হলেন যাদব, ভারতের শেষ উইকেটের পতন ঘটল, সঙ্গে সঙ্গে পুরো স্টেডিয়াম ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রবে ফেটে পড়ল। সঙ্গে এও শোনা গেল, ‘মওকা, মওকা’। ক্রিকেটাররা একেকজন আনন্দে একেকদিকে ছুটতে শুরু করলেন। আনন্দের সীমা থাকল না। মাশরাফি-তাসকিন মিলে বিশ্বকাপের মতো যুদ্ধংদেহী পুরনো সেই চিত্র আবারও ফুটিয়ে তুললেন। যার নাম হয়ে গেছে, ‘ম্যাশকিন’ শো। ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রতিশোধ নিয়েছে বাংলাদেশ, তা দেখতে পুরো জাতির চোখ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের দিকে ছিল। তাদের মনের আশা পূরণ হলো। ক্রিকেটাররা যেভাবে একেকজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরলেন, যেভাবে উল্লাস করতে থাকলেন, নাচতে থাকলেন, তাতে তাদের মনেও যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল, তাই কী বোঝা গেল না? এ জয়টি পাওয়াতে তো বাংলাদেশ র‌্যাঙ্কিংয়ের ৭ নম্বরেও উঠে গেল। এখন ভারতের বিপক্ষে বাকি থাকা ২টি ম্যাচ ও জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অনুষ্ঠেয় ৩টি ওয়ানডের মধ্যে যে কোন একটি ম্যাচ জিতলেই ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেবে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে যে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ, তাতে এ সিরিজেই যে আরেকটি ম্যাচ জেতা সম্ভব, পাকিস্তানের পর ভারতকেও সিরিজে হারানো সম্ভব; সেই ভিত মজবুতই হয়ে গেল। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হতেই আশার বেলুন উড়তে থাকে। জয়ের প্রত্যাশাও শুরু থেকেই থাকে। ভারতের বিপক্ষে যে রেকর্ড ৩০৭ রান করে বাংলাদেশ। কিন্তু মুশফিক সব আশায় যেন গুড়েবালি ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন। ডুবাচ্ছিলেন বাংলাদেশকে। এক এক করে ধাওয়ানরে দুটি নিশ্চিত ক্যাচ মিস করে ফেললেন! তাতে উইকেটের পেছনে মুশফিকের থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। সঙ্গে ভারতের বিপক্ষে হারের শঙ্কাতেই পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তামিম ইকবালের ৬০, সৌম্য সরকারের ৫৪, সাকিব আল হাসানের ৫২, সাব্বির রহমান রুম্মনের ৪১, নাসির হোসেনের ৩৪, মাশরাফি বিন মর্তুজার ২১ রানে তিন ম্যাচের ওয়ানডের সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে জয়ের আশা জাগিয়েও শঙ্কা তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু অভিষেক ওয়ানডেতেই ৫ উইকেট নেওয়া মুস্তাফিজ, ২ উইকেট করে নেয়া তাসকিন ও সাকিব, ১ উইকেট নেয়া মাশরাফির দক্ষ বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতকে ৪৬ ওভারে ২২৮ রানে অলআউট করা গেছে। হারানোও গেছে। প্রতিশোধও নেয়া গেছে। এ জয়ে ১০ বছর আগের কার্ডিফের স্মৃতিও যেন ফিরে আসল। মিরপুর যেন হয়ে উঠল কার্ডিফও। যদিও ১৮ জুন ২০০৫ সালের সেই ম্যাচের প্রতিপক্ষ ভারত ছিল না। ছিল অস্ট্রেলিয়া। এর পরও সেদিন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো জিতে বিশ্ব ক্রিকেট দরবারে বাঘের গর্জন শুনিয়েছিল বাংলাদেশ, এবার মিরপুরে সেই দিনের স্মৃতিই জাগিয়ে তুলল বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে টানা ৫ ওয়ানডেতে জয়। এরপর বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা। পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজেও টানা ৩ ম্যাচে জয়। এবার ভারতের মতো পূর্ণশক্তির দলকে হারিয়ে দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে টানা ৯ ম্যাচে জিতে আবারও কী বিশ্ব ক্রিকেট কাপিয়ে দিল না বাংলাদেশ? মাশরাফি যে প্রথম ওয়ানডেতে নামার আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে সেরা দল। জয়ের সংখ্যা অন্য যে কোন দলের চেয়ে ভাল। তার প্রমাণই কী মিলল না? ধাওয়ান ১১ ও ১৫ রানে দু’বার মুশফিকের হাত থেকে বেঁচেও খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। ৩০ রানে তাসকিনের বলে আউট হয়ে গেছেন। চার পেসার নিয়ে খেলে শুরুতে সমালোচনা হলেও ভারত ইনিংসে মাশরাফি, রুবেল, তাসকিন, মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং প্রশংসাই কুড়িয়েছে। ভারতের প্রথম উইকেট তুলে নিতে যদিও ৯৫ রান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো, তবে এরপর যে উইকেট পড়তে শুরু হলো, ১০১ রানে বিরাট কোহলি (১), ১০৫ রানে রোহিত শর্মা (৬৩), ১১৫ রানে আজিঙ্কেয়া রাহানে (৯), ১২৮ রানে মহেন্দ্র সিং ধোনি (৫) আউট হয়ে গেলেন। এর মধ্যে দলের সেরা স্পিনার সাকিব ২৬তম ওভারে বল করতে আসলেন! এসেই ধোনির উইকেটটি তুলে নিলেন। এ ছাড়া বাকি ৪টি উইকেটের ২টি তাসকিন, ২টি মুস্তাফিজ শিকার করলেন। ষষ্ঠ উইকেটে গিয়ে যখন সুরেশ রায়না ও রবীন্দ্র জাদেজা বড় জুটি গড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, ধোনির ধাক্কায় বুকে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছাড়া মুস্তাফিজ ফিরেই আবার ভারত ইনিংসে আঘাত হানতে থাকেন। রায়না-জাদেজার ৬০ রানের জুটি ভেঙ্গে ফেলেন। তাতে ভারতের হার যেন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮ রানে রায়নাকে (৪০) আউট করার পরের বলেই আবার রবীচন্দ্রন অশ্বিনের (০) উইকেটটি শিকার করে নেন মুস্তাফিজ। হ্যাটট্রিকের আশা তৈরি করেন। কিন্তু তা হয়নি। তবে ১৯৫ রানে জাদেজাকে (৩২) আউট করে দিয়ে অভিষেক ওয়ানডেতেই বাংলাদেশের হয়ে তাসকিন আহমেদের (ভারতের বিপক্ষে গতবছর) পর ৫ উইকেট তুলে নেন মুস্তাফিজুর রহমান। নিজের শেষ ওভারে মোহিত শর্মার ক্যাচটি লুফে নিতে পারলে বাঁহাতি পেসারদের মধ্যে অভিষেক ওয়ানডেতেই ৬ উইকেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটও পেতেন, বিশ্বরেকর্ড গড়তে পারতেন। কিন্তু যা দেখালেন, এতেই বাংলাদেশ জিতল। আর তাতে মুস্তাফিজ আনন্দে ভাসতেও থাকলেন। ভারত অলআউট হতেই মুস্তাফিজকেই সবাই ঘিরে ধরল। সকাল থেকেই রোদ আর মেঘের খেলা হয়েছে। কখনও রোদ ঝলমলে আকাশ দেখা গেছে। কখনও আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। শেষে বাংলাদেশ ইনিংসে একবার বৃষ্টি হানা দিয়েছে। তাতে এক ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকলেও, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত প্রথম ওয়ানডে একদিনেই শেষ হয়েছে। রিজার্ভ ডেতে যায়নি। তাতে করে বাংলাদেশ জয় তুলে নিয়ে সিরিজেও এগিয়ে গেল। ম্যাচে শুরু থেকেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করতে থাকেন তামিম- সৌম্য। ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে ১০২ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন। এমন সময়ে সৌম্য আউট হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামে। এক ঘণ্টা ১৪৬ রানের মধ্যে লিটন কুমার দাস (৮) ও মুশফিক (১৪) সাজঘরে ফেরেন। এরপর সাকিব-সাব্বির মিলে পঞ্চম উইকেটে ৮৩ রানের জুটি গড়ে দলের বেহাল দশা কাটান। ২২৯ রানে এ জুটি ভাঙ্গার পর আর কোন বড় জুটির দেখা মিলেনি। তবে সাকিব, নাসির, মাশরাফিরা যে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন, তাই বাংলাদেশকে ৩০৭ রানে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাতে জয়ও মিলে যায়। সেই জয়টি পুরো জাতির মনে প্রশান্তিও এনে দেয়। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে রোহিত শর্মা আউট হলেও রুবেলের ফুলটস বল ‘নো’ ডাকা হয়। সুরেশ রায়না’র এলবিডব্লিউ দেয়া হয়নি। ধাওয়ান বাউন্ডারির দড়ি ছুয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ক্যাচ ধরেন, এর পরও রিয়াদকে সাজঘরে ফিরতে হয়েছে। এতসব সিদ্ধান্ত যখন একটি দলের বিপক্ষে যায়, তখন কী আর সেই দল জেতে? বিশ্বকাপে মেলবোর্নে বাংলাদেশ জিতেনি। তবে এবার মিরপুরে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ত স্কোর ॥ বাংলাদেশ ইনিংস ৩০৭/১০; ৪৯.৪ ওভার (তামিম ৬০, সৌম্য ৫৪, সাকিব ৫২, সাব্বির ৪১, নাসির ৩৪, মাশরাফি ২১; অশ্বিন ৩/৫১)। ভারত ইনিংস ২২৮/১০; ৪৬ ওভার (রোহিত ৬৩, রায়না ৪০, জাদেজা ৩২, ধাওয়ান ৩০, ভুবনেশ্বর ২৬*; মুস্তাফিজ ৫/৫০, তাসকিন ২/২১, সাকিব ২/৩৩, মাশরাফি ১/৫৩)। ফল ॥ বাংলাদেশ ৭৯ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা ॥ মুস্তাফিজুর রহমান (বাংলাদেশ)।
×