ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টলারে ভাসছিল। এদের মরিচের গুঁড়ো দিয়ে ভাত দেয়া হতো একবার

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৯ জুন ২০১৫

টলারে ভাসছিল। এদের মরিচের গুঁড়ো দিয়ে ভাত দেয়া হতো একবার

নিজস্ব সংবাদদাতা, চুয়াডাঙ্গা, ১৮ জুন ॥ মানবপাচারকারীদের হাত থেকে ফিরে আসা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কেদারনগর গ্রামের কিশোর আরিফ বলেন, কক্সবাজারের নিকট এক পাহাড়ের হোটেলে আমাকে রেখেছিল দু’দিন। আমার মতো আরও অনেক ছেলে ছিল। শেষদিন রাত ২টার দিকে আমাদের হাত পেছনে ও কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে একটা ট্রলারে তোলে। ট্রলারে থেকে ছোট জাহাজে তোলে। টলারে থাকতে দালালরা অনেকের মতো আমাকেও মারধর করে। পরে বাবার নিকট মোবাইল ধরিয়ে ৪০ হাজার টাকা পাঠাতে বলেছিল। তা না হলে হত্যা করবে বলেও হুমকি দেয়। আমার বাবা জানতে পেরে আনারুলের নিকট ৪০ হাজার টাকা পৌঁছে দিয়েছিলো। জাহাজে আমরা মোট ৪শ’ লোক ছিলাম। ১৮ দিন কাটে এ জাহাজে। ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার মাত্র এক মগ পানি ও এক প্লেট ভাত শুকনো ঝালের গুঁড়ো দিয়ে খেতে দিতো। এছাড়া রাত-দিনে পেতাম ২ মগ পানি। তার বেশি কেউ পানি কিংবা ভাত চাইলেই কাঠের লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটাত। খাবারের জন্যে আকুতি করায় এমন অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো শুধু আমাকেই নয়, সবাইকে। একজনের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার দেখে আর কেউ খাবার কিংবা পানি চাইত না। মরে গেলেও কেউ সহজে মুখ খুলত না। গত ২১ মে মিয়ানমার থেকে উদ্ধার হওয়া ১৫০ জন বাংলাদেশীর সঙ্গে দরিদ্র সুন্নত আলীর ছেলে আরিফসহ চুয়াডাঙ্গার ৪ জনকে উদ্ধার করে নৌবাহিনীর সদস্যরা। এরা অর্ধাহারে অনাহারে থাইল্যান্ডের নিকট সাগরে মধ্যে টিন-এজার ৪ জনকে গত ১১ জুন কক্সবাজারের বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নিকট হস্তান্তর করা হয়। বুধবার কেদারনগর গিয়ে আরিফের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরিফ জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে তার নিজ গ্রামের ওসমানের ছেলে আনারুল ইসলাম তাকে পানিপথে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়। ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই যাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করে সে। এমনকি টাকাও নগদ দিতে হবে না। পরে কাজ করে পরিশোধ করতে হবে বলে জানায়। আনারুল তাকে বার বার প্রলুব্ধ করতো। এক পর্যায়ে আরিফ রাজি হয় মালয়েশিয়া যেতে। প্রায় দেড় মাস পূর্বে দালাল আনারুল তাকে সঙ্গে করে আলমডাঙ্গার ৮ কপাট নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে ওসমান নামের আরেক দালালের হাতে তুলে দেয়। ওসমান তাকে সঙ্গে করে প্রথমে ঢাকা ও পরে কক্সবাজার নিয়ে যায়। সেখানে কয়েকদিন অনেক কিশোরের সঙ্গে তাকেও রাখা হয় এক হোটেলে। তাদেরকে নতুন করে পাহাড়ের অন্য এক হোটেলে আটকে রাখে। ২ দিন পর এক রাতে হাত-চোখ বেঁধে জোর করে তোলা হয় টলারে। ১৮ দিন টলারে চড়ে সাগরে ভাসতে থাকে তারা। তারপর মিয়ানমারের জঙ্গলে ২০ দিন ছিল পালিয়ে। সেখানে রাখাইন গোত্রের অনেক দালালের হাতে অস্ত্রও রয়েছে। কেউ কথা বললেই লাঠি দিয়ে মারধর করা হতো। সেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে ২০ দিন দুর্বিষহ কষ্টে কেটেছে। আরিফ পথের দুঃসহ বর্ণনা দিয়ে বলে, ‘বর্ডারে কড়াকড়ির কারণে ভেতরে যাওয়া যাচ্ছিল না। তখন তাদেরকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলেও শুনেছিলো সে। কিন্তু এক বার্মিজ মাঝি তাদেরকে রক্ষা করে বলেনÑ এরাও তো মানুষ, আমি এদের ফিরিয়ে দিয়ে যাবো। মিয়ানমারের সাগরের নিকট নিয়ে যান তিনি। পরে ওই বার্মিজ মাঝি তাদেরকে নৌকায় তুলে দিলে মিয়ানমারের কোস্টগার্ড তাদেরকে উদ্ধার করে সেন্টমার্টিনের নৌকায় উঠিয়ে দেন।
×