ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কেন আলবদরদের জন্য ফাঁসিও যথেষ্ট নয়

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৮ জুন ২০১৫

কেন আলবদরদের জন্য ফাঁসিও যথেষ্ট নয়

আলবদর কমান্ডার মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে ট্রাইব্যুনাল। রায়ে এটি সর্বোচ্চ শাস্তি হলেও ৭১-এ তার অপরাধের পরিধি এতই ব্যাপক ছিল যে, কেবল ফাঁসিই তার জন্য যথেষ্ট নয়- গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর আজ দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন সম্পাদকীয় পাতায়- সাংবাদিক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন- ‘ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যার অনেক কাহিনী পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ওই পিশাচরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দু’টুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন্্ পাশবিকতার উল্লাস? ... সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকত, এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না, আর মানুষ কেন, কোন প্রাণীই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?... শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি, ভুল বললাম মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকায় মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়?’ আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’ [দৈনিক পূর্বদেশ, ৮.১.১৯৭২] আলী আকবর টাবী দৈনিক আজাদ উদ্ধৃত করে লিখেছেন, গ্রেফতারকৃত এক আলবদর স্বীকার করেছিল- ‘আর এক সপ্তাহ সময় পেলেই আলবদর বাহিনী সকল বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলত।’ [আলী আকবর টাবী, মতিউর রহমান নিজামী, আলবদর থেকে মন্ত্রী ঢাকা, ২০০৭] ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক বছর খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে এ ধরনের প্রচুর বধ্যভূমির খবর জানা যাবে। বধ্যভূমি থেকে কেউ ফিরে আসে না, আসেনি। ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমি, যেখানে আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক বধ্যভূমির প্রতীক। এই সমস্ত হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা, যাদের প্রধান অংশ ছিল জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। এদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল রাজাকার বাহিনী, ডেথ-স্কোয়াড নামে খ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনী। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বাঙালী এসব হত্যাকা- ভুলে গিয়েছিল। এসব দেখে বাঙালী মানসিকতা ভাবা নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। জেনেটিক্যালি এদের কোথায় যেন গ-গোল আছে। ভুলে যাওয়ার এক অসম্ভব ক্ষমতা আছে বাঙালীর। অনেকে বলেন, বাঙালী ক্ষমাশীল। আমি মনে করি, না তা নয়। তা হচ্ছে ভ-ামি, সুবিধাবাদ ও নিষ্ঠুরতা। বাঙালীর ভ-ামির, ধর্মহীনতা, সুবিধাবাদ ও নিষ্ঠুরতার দিকটি প্রকাশ পেয়েছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কর্মকা-ে। আমরা সেসব ভুলে গেছি। এ উপলক্ষে আরেকবার তা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি। তবে তার আগে মুজাহিদদের কীর্তিকলাপের শেষাংশ বর্ণনা করি। ॥ ৪ ॥ আলবদররা সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করেছিল, যাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মুখথুবড়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে পারে একথা আলবদররা কখনও ভাবেনি। কিন্তু সেই পাকিস্তানী বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ শুরু করল তখন আলবদররা বিচলিত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সেনারা নির্দেশ দেয় তাদের আত্মসমর্পণ করতে। তারা তাদের দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। তখন আলবদররা পালাতে শুরু করে। তাদের শেষ সময়কার বর্ণনা পাই খালিদ মনসুরের লেখায়। তিনি লিখেছেন: ঢাকার পতনের পর ‘বীর’ আলবদররা পালাতে থাকে। মনসুর লিখেছেন, পতন যখন আসন্ন তখন আলবদররা দিশেহারা অবস্থায় নির্দেশনার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রভুরাও পালাতে ব্যস্ত। কে কাকে নির্দেশনা দেয়! বিকেলে যখন রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলছে তখন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা সদর দফতরে ঢাকার আলবদররা মিলিত হলো, তাদের প্রভুদের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তে তারা ‘পেরেশান’ এবং তাদের কী হবে এ ভেবে ছিল উদ্বিগ্ন ও ‘ক্রন্দনরত’। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান নাজেম আলী আহসান মুজাহিদ আলবদরদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। খালেদ লিখেছেন, ঐখানে যেসব আলবদর উপস্থিত ছিল তাদের কাছ থেকে শুনে তিনি এই বক্তৃতাটি সঙ্কলন করেছেন এবং পরে মুজাহিদ তা সংশোধন করে সত্যায়িত করেছেন। ভাষণটি উদ্ধৃত হলোÑ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্ল্ল্লাাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু ইন্না সালাতী’ নিশ্চয়ই, আমার নামাজ আমার কুরবানি আমার জীবন ও আমার মৃত্যু একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য। মুজাহিদ সাথীরা, আমাদের দেহ ও প্রাণ শুধু এবং শুধুই ইসলামের জন্য, আমরা ইসলামের জন্যই এসব কাজ করছি। মাঝে আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসুলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাত অনুযায়ী সঠিক বলে জানতাম। আমরা পাকিস্তানকে উপাস্য মনে করে নয়, মসজিদ মনে করে আমাদের ঝুঁকি ও আমাদের ভবিষ্যতকে এর ওপর ন্যস্ত করেছিলাম। আমাদের এই কাজ কেউ গ্রহণ করল কি করল না এর পরওয়া করি না। যার কবুল করা উচিত তিনি তো জানেন যে, আমাদের সামনে তার সন্তুষ্টিই ছিল মুখ্য। এটা আল্লাহরই ইচ্ছা ছিল যে, আমরা জীবনবাজি রেখে বেরিয়ে পড়ব। পরীক্ষায় সেই মুহূর্তে আমরা তার কাছ থেকেই সাহায্য চেয়েছি এবং তার ওপর ভরসা করেই ঐ নাজুক পরিস্থিতিতে মিশে না যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ওহে মজলুম পাকিস্তানের অসহায় সন্তানরা, আমাদের সঙ্গে আজকে যা-কিছু হওয়ার গতকাল সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলাম। আর আজকে আমরা সে বিষয়ে ওয়াকেবহাল যা আসন্ন আগামীকাল আমাদের জন্য নিয়ে আসবে। আমরা চলে যাওয়া গতকালের জন্য না লজ্জিত, আর না আসন্ন আগামী দিনের জন্য নিরাশ। আজকের সূর্যটি একটি কঠিন পরীক্ষা সামনে নিয়ে উদিত হয়েছে। আর আগামীকালটি উদিত হবে ধিকি ধিকি আগুনের কয়লা বৃষ্টি নিয়ে।... আমরা বিশ্বাস করি যে, এই প্রাণ দিয়ে দেয়া এমন বিরাট সৌভাগ্য যার চিন্তাও করা যায় না। আপন খোদার সঙ্গে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বেহেশত ক্রয় করার আগে কি আমরা ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করিনি? ওহে দুনিয়া ভরা সকল সাফল্যের চেয়ে প্রিয় বন্ধুরা, আপনারা আজকেও এক সময়ের অতি মূল্যবান সম্পদ দ্বীনকে কায়েম করা, সত্যের সাক্ষ্য দেয়া ও ইসলামী বিপ্লবের জন্য আপনাদের জীবনকে হেফাজত করা আপনাদের ওপর ফরজ। (চলবে)
×