ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোজা ও ঈদ সামনে রেখে নৌ দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্যোগ;###;আট মিনিট পর পর যাত্রীবাহী লঞ্চ ছাড়ার সিদ্ধান্ত ;###;উদ্ধারকারী জাহাজ আগাম প্রস্তুত রাখা হচ্ছে

দুর্ঘটনাপ্রবণ কয়েক ঘাটে খোলা হচ্ছে মনিটরিং সেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৮ জুন ২০১৫

দুর্ঘটনাপ্রবণ কয়েক ঘাটে খোলা হচ্ছে মনিটরিং সেল

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পবিত্র রমজান ও ঈদ বর্ষা মৌসুমে পড়ায় এবার নৌপথে যাতায়াত অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতি ১৫ মিনিটের পরিবর্তে প্রতি ৮ মিনিট পর পর যাত্রীবাহী লঞ্চসহ অন্যান্য জলযান ছাড়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ মাওয়া, কাওড়াকান্দি, আরিচা, দৌলতদিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশাল নৌ ঘাটগুলোতে। এসব ঘাটে প্রজেক্টরের মাধ্যমে যাত্রী ও জলযানের চালকদের সচেতনতা বাড়াতে নানা ভিডিও দেখানো হবে। দুর্ঘটনা কবলিত নৌযান উদ্ধারে বিআইডব্লিউটিয়ের তরফ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ আগাম প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। আর নদীপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নৌ-পুলিশের ৩৯টি জলযান সর্বক্ষণিক টহলে থাকছে। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলতি সপ্তাহেই আবারও শুরু হচ্ছে নৌ-ডাকাত ও চাঁদাবাজদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান। সম্প্রতি পরিচালিত অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে ৬০ জন নৌ-ডাকাত ও চাঁদাবাজ। তাদের তথ্য মতে নৌ-ডাকাত ও নৌপথে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অন্তত দুশ’ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের গ্রেফতার করতেই নতুন করে অভিযান শুরু হচ্ছে। নৌ-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে নৌপথে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে। এবার বর্ষায় রমজান ও ঈদ হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকটা বেশি। বর্ষার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নদী পথের সীমানা সাধারণত প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হয়। এবার ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা থাকায় তা বেড়ে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারে দাঁড়াতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে নৌপথ কমে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়ায়। নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৭৬টি নৌ-ফাঁড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ৪৬টি ফাঁড়ি পুরোদমে কাজ করছে। অন্য ফাঁড়িগুলো কাজের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নৌ দুর্ঘটনা বা অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট জেলা থানাতে দায়ের হচ্ছে। থানা পুলিশ ব্যস্ততাসহ নানা কারণে সঠিকভাবে মামলার তদন্ত করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে গাফিলতির কারণে অধিকাংশ আসামি গ্রেফতার হয় না। মামলা তদন্তে গতি না থাকায় এবং আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। আসামিরা অনায়াসে পারও পেয়ে যাচ্ছে। মামলার তদন্ত নিয়ে নৌ-পুলিশ আর থানা পুলিশের মধ্যে রশি টানাটানিতে নৌপথের অপরাধীদের অধিকাংশই গ্রেফতার হয় না। এমনকি এসব অপরাধী সর্ম্পকে সঠিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য এসব মামলা নৌ-ফাঁড়িতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। নৌ-পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সারাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চল হিসেবে ভাগ করা হয়েছে। পাশাপাশি নৌপথে ডাকাত ও চাঁদাবাজদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তথ্য মোতাবেক চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। নৌ-পুলিশের নেতৃত্বে জেলা পুলিশের সহযোগিতায় ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে গ্রেফতার হয় নৌ-ডাকাত ও নৌপথে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অন্তত ৬০ জন। সম্প্রতি অভিযানকালে চাঁদপুরে নৌ-ডাকাতদের সঙ্গে নৌ-পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে এক নৌ-ডাকাত নিহত ও অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। গ্রেফতারকৃত নৌ-ডাকাত ও নৌ-চাঁদাবাজদের অনেকেই একাধিক মামলার আসামি। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলার থানাগুলোতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের তথ্য মোতাবেক প্রায় দুশ’ নৌ-ডাকাত ও চাঁদাবাজের নাম পাওয়া গেছে। এলাকাভিত্তিক এসব নৌ-ডাকাত ও নৌপথে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করা হয়েছে। তালিকা মোতাবেক রমজান শুরুর প্রথম সপ্তাহ থেকেই জেলা পুলিশ ও নৌ-পুলিশের সমন্বয়ে বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে। জলে ও স্থলে একসঙ্গে অভিযান চালানো হবে। কারণ জলপথে অপরাধ করে অপরাধীরা স্থলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অভিযান চালাতে প্রস্তুত করা হয়েছে ২০টি কান্ট্রি বোট (স্বল্প গতিসম্পন্ন ইঞ্জিনচালিত জলযান) ও স্পীড বোট (দ্রুত গতিসম্পন্ন জলযান)। এসব জলযান অভিযানের পাশাপাশি নৌপথে টহলসহ নানা কার্যক্রমে অংশ নিবে। এবার রমজান ও ঈদে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। এছাড়া রমজান ও ঈদে মাওয়া, কাওড়াকান্দি, আরিচা, দৌলতদিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশাল নৌ-ঘাঁটগুলোতে মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে। সেলগুলোতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে লঞ্চের সারেংসহ সংশ্লিষ্টদের জলযান চালানো, যাত্রী ওঠানামা, আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যাদি সর্ম্পকে সচেতন করতে স্বল্পমেয়াদী বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জলযানগুলো যেসব পথে যাতায়াত করবে সেই পথে নদীর গভীরতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ও অসুবিধার বিষয়াদি তুলে ধরা হবে। জলপথে যাতায়াতকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণ, প্রজেক্টরের মাধ্যমে নদীপথের সার্বিক পরিস্থিতি দেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য নতুন সাতটি প্রজেক্টর কেনার প্রক্রিয়া চলছে। মনিটরিং সেল প্রতিটি জলযানের ধারণ ক্ষমতা এবং সে অনুযায়ী যাত্রী বা মালামাল উঠানো হচ্ছে কিনা তা বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ-পুলিশ যৌথভাবে মনিটরিং করবে। নদীপথে ডাকাতি প্রবণ এলাকা হিসেবে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর শাহ সিমেন্ট কারখানা এলাকা থেকে কুমিল্লার ষাটনল পর্যন্ত এলাকা ডাকাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া অন্য এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে চাঁদাবাজি প্রবণ এলাকা হিসেবে। সাধারণত বালুবাহী জলযানগুলোতে চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। যে এলাকা থেকে বালু জলযানে ভরা হয়, সেই এলাকায় এবং যেসব এলাকার নদীপথ দিয়ে বালুবাহী জলযান চলাচল করে সেই এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটে। নৌ-পথ নিরাপদ করতে সরকার কড়া নির্দেশ জারি করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় নদীমাতৃক বাংলাদেশে আবার নদীপথে যাতায়াতের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এক সময় চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল জলপথ। কিন্তু কালের গর্ভে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। ভূমি দস্যুদের থাবায় দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেশের নদ-নদী-খাল-বিল-পুকুর-ডোবা। স্বাভাবিক কারণেই কমে যাচ্ছে নৌপথে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা। ফলে সারাদেশে থাকা ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কের ওপর দিন দিন যানবাহন চলাচলের চাপ বেড়েই চলেছে। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যানবাহনের চাপ বাড়ায় সারাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসব দুর্ঘটনায় গড়ে চার থেকে সাড়ে চার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয় অন্তত সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার জনকে। এছাড়াও সড়ক মহাসড়কে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে আরও হতাহত ও পঙ্গুত্বের ঘটনা ঘটে। এজন্য সরকার সড়ক পথে যানবাহনের চাপ কমিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে নির্মিত ৭৫০ যাত্রী ধারণক্ষম এম ভি বাঙ্গালী নামের একটি বহুতল লঞ্চের উদ্বোধন করেন। ওই লঞ্চে চড়েই তিনি ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে চাঁদপুরে যান। সেখানে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নদী দখল, দূষণ, নৌপথের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কম খরচে আরামদায়ক যাতায়াতসহ নানা সুবিধার কথা তুলে ধরেন। মানুষকে নৌপথ ব্যবহারে আগ্রহী হতেও পরামর্শ দেন। পাশাপাশি নৌপথে যে কোন ধরনের অপরাধ দমনে কঠোর নির্দেশও প্রদান করেন তিনি। সরকারের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালের ১২ নবেম্বর বাংলাদেশ পুলিশে স্বতন্ত্র নৌ-পুলিশ শাখা চালু হয়। বর্তমানে নৌ-পুলিশে জনবলের সংখ্যা প্রায় ১২শ’। যা দুই হাজারে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে। সেইসঙ্গে দেশের নদীপথের সার্বিক দিক দেখ-ভাল করতে নৌ-পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতর, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস অধিদফতর, নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়। নৌ-পথে দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে নদী দখল, দূষণ, নদীর গভীরতা, নদীর পাড়ের কৃষি কাজ ও কৃষি জমি, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, নদীতে মৎস্য সম্পদ বাড়ানো, মৎস্য প্রজননের পরিবেশ সৃষ্টি, কৃষি সেচ ব্যবস্থাসহ নদী সংক্রান্ত সব কিছুই দেখ-ভালসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্বও রয়েছে মনিটরিং সেলটির ওপরে। সার্বিক বিষয় সর্ম্পকে নৌ-পুলিশ প্রধান উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এমডি মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি নৌ-পুলিশের নেতৃত্বে জেলা পুলিশের সহযোগিতায় পাঁচটি জেলায় অভিযান চালানো হয়েছে। নৌপথের অনেক অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে। রমজান ও ঈদ উপলক্ষে আবারও অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চলছে। গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটগুলোতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে জলযানের চালক ও যাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানাবিষয় তুলে ধরা হবে। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, এজন্য এবার কয়েক মিনিট পর পর জলযান ছাড়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা চলছে। নৌ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলা সংশ্লিষ্ট জেলার থানাগুলোতে দায়েরের বিষয়ে তিনি জানান, সরকার নৌ-ফাঁড়িগুলোকে থানায় উন্নীত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। নৌ-পুলিশের নিজস্ব থানা হলে নৌ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সব মামলা নৌ-থানায় হবে। নৌ-থানা পুলিশ মামলার তদন্ত করবে। এতে করে জেলা থানার ওপর চাপ কমবে।
×