ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির জন্য ভূমি বিরোধ অবসান জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ জুন ২০১৫

পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির জন্য ভূমি বিরোধ অবসান জরুরী

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী ॥ ভূমির মালিকানা নিয়ে পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের অবসান প্রক্রিয়া প্রতিবন্ধক হিসেবে থাকায় ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির সফলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে আছে। ভূমি নিয়ে বিরোধের বিষয়টি অব্যাহত থাকায় পাহাড়ের ভুক্তভোগী বাঙালী ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ছোট বড় হানাহানির ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে একই ভূমির মালিকানা বাঙালীরা যেমন দাবি করছে, তেমনি পাহাড়ীরাও দাবি করছে। পাহাড়ীদের দাবি- পাহাড়ের সকল জমির মালিক পাহাড়ী সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে সরকার যেসব বাঙালীকে সেটেলার হিসেবে সেখানে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে এবং এর বিপরীতে ভূমির মালিক দাবিদার বাঙালীদের দিয়েছে ‘কবুলিয়ত’। যা জমির মালিকানার পক্ষে দলিল হিসেবে দাবি করে আসছে সংশ্লিষ্ট বাঙালীরা। কিন্তু পাহাড়ের জনগণ এ ধরনের কবুলিয়তের বিপরীতে জমির মালিকানা সেসব বাঙালী হতে পারে না বলে দাবি জানিয়ে আসছে। জনসংহতি সমিতির পক্ষে এর প্রধান সন্তু লারমাও শান্তি চুক্তিতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে যেসব কথা বলা আছে তা সম্পূর্ণভাবে মানতে নারাজ। যে কারণে তিনি শান্তি চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার সমালোচনাকারী ও বিরোধিতাকারীদের অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে জনসংখ্যার দিক থেকে বর্তমানে পাহাড়ী-বাঙালী প্রায় সমান সমান অবস্থান রয়েছে। এছাড়া পাহাড়ে বাঙালীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাঙালী জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ বিষয়টি খুব একটা ভাল চোখে দেখা হয় না। শুধু তাই নয়, এ কারণে বাঙালী বিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট গড়ে তুলতে জনসংহতি সমিতির দু’গ্রুপ এবং ইউপিডিএ সব সময় সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। আর এ কারণে পাহাড়ী ও বাঙালীদের মাঝে সাম্প্রদায়িক উস্কানিসহ বিভিন্ন ধরনের হানাহানি ও সংঘাতের জন্ম দিতে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। পাহাড়ে বর্তমানে উভয় সম্প্রদায়ের অশান্তির নেপথ্যে সবচেয়ে বড় যে কারণটি নিহিত রয়েছে সেটি হচ্ছে ভূমি নিয়ে সমস্যা। শান্তি চুক্তির দীর্ঘ প্রায় আঠার বছরেও এ সমস্যাটির কোন কূল কিনারা করা যায়নি। ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, কাউখালি, রাজস্থলি, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, দীঘিনালা ও পানছড়িতে প্রায়শ পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে অশান্ত পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। এ অশান্ত পরিস্থিতি মাঝে মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ৯ সদস্যের একটি ল্যান্ড কমিশন গঠনের কথা বিদ্যমান। এ কমিটির সদস্যরা হবেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, পাহাড়ীদের তিনটি সার্কেলের তিন রাজা অর্থাৎ চাকমা রাজা, মং রাজা ও বোমাং রাজা। এছাড়া এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের তিন চেয়ারম্যান। শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সরকার ১৯৯৯ সালের ৩ জুন বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠন করে প্রথম ভূমি কমিশন। তিনি কমিশনের কার্যভার গ্রহণের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল সরকার বিচারপতি আবদুল করিমকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি এ কমিশনের কোন কাজে হাত দেয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালের ২৯ নবেম্বর বিচারপতি মাহমুদুর রহমানকে পার্বত্য ভূমি কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। ওই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের জন্য সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করেন। এ অবস্থায় ভূমি কমিশন আইন ২০০১ পাস হয়। এ অবস্থায় আবারও পরিবর্তন আসে কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। বিচারপতি খাদেমুল ইসলামকে কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হককে ভূমি কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় সরকার। আইন সংশোধন না হওয়ায় তিনিও এ বিষয়ে কার্যকর কোন কর্মকা- শুরু করতে পারেননি। যার ফলে পাহাড়ে ভূমি নিয়ে বিরোধ এবং অশান্তি জিইয়ে রয়েছে। অপরদিকে, একশ্রেণীর ভূমিদস্যু পুনর্বাসিত এলাকায় রাতারাতি জমির ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে পাহাড়ে বসতি গেঁড়ে বসেছে। এসব জমি রোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বেচাকেনাও হচ্ছে। যার ফলে বাঙালী ও পাহাড়ীদের অনেকের ভূমি বেদখল হয়ে হাতছাড়াও হয়ে যাচ্ছে। এদিকে, ভূমি কমিশনের আইনে কিছু সংশোধনী আনয়নে জেএসএস আন্দোলন শুরু করলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জেএসএস-এর সঙ্গে কয়েকদফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জেএসএস ভূমি সংশোধন নিষ্পত্তি আইন ২০০১ সংশোধনের জন্য সরকারের কাছে ২৯টি সংশোধনী পেশ করেছে। এসব সংশোধনী নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে একাধিক সভাও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৩টি বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ নিয়ে একটি বিল সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর তা যাচাই বাছাই করার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। অপরদিকে, জনসংহতি সমিতির এসব সংশাধনীর বিরুদ্ধে আপত্তিও উঠেছে। এসব আপত্তিতে বলা হয়েছে, জেএসএস এর সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র ৩০ শতাংশ ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তি হতে পারে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ ভূমি নিয়ে বিরোধ থেকেই যাবে। কারণ, সংশোধনী প্রস্তাবে বেদখল হয়ে যাওয়া জমির স্বত্ব বাতিলের এবং মূল মালিককে তার জমি ফিরিয়ে দেয়ার কথা আসেনি। জেএসএস-এর পক্ষ থেকে ৫টি সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে ভূমি বিষয়ক কমিটি উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব করেছে। আঞ্চলিক পরিষদ চায় চলতি সংসদ অধিবেশনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের সংশোধনী বিল উত্থাপন করা হোক। পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় বাঙালী ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সকল সদস্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সরকারী জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করার পথ চেয়ে আছেন। কারণ, এ বিরোধ শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হলে পাহাড়ে অনাকাক্সিক্ষত অধিকাংশ ঘটনার অবসান যে ঘটবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে জেএসএসের পক্ষ থেকে পাহাড়ের সকল জমির মালিক পাহাড়ীরা- এমন বক্তব্য বাঙালী সম্প্রদায়ের আদি বাসিন্দাসহ সকলেই ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে আছেন। কেননা, পাহাড়ে বাঙালীদের তুলনায় পাহাড়ী অদিবাসীর সংখ্যা বেশি হলেও তাদের সঙ্গে বাঙালীদের অবস্থানও রয়েছে। সঙ্গত কারণে জমির মালিকানা নিয়ে এককভাবে পাহাড়ীদের বলে দাবি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে আদি বাঙালীদেরও মত রয়েছে।
×