ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বীরের এ রক্ত স্রোত মাতার এ অশ্রু ধারা...সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৭ জুন ২০১৫

বীরের এ রক্ত স্রোত মাতার এ অশ্রু ধারা...সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা

আরাফাত মুন্না ॥ মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে...? বাঙালী জাতির ইতিহাস অশ্রুজলেরই। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ প্রাণ বলিদানের মধ্য দিয়েই এসেছিল এ স্বাধীনতা। প্রাণ দিয়েছিল রুমি, বদি, জুয়েলের মতো টগবগে তরুণরা। যাদের অনেকের নাম লেখা শুধু অশ্রুজলে। আবার সুরকার আলতাফ মাহমুদ বাদ যাননি শিক্ষক সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীরা। ঝরেছে কত মায়ের অশ্রু। ওই সময় নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের। শাফি ইমাম রুমি। একাত্তরে তার বয়স কতই বা ছিল। ১৯ কি ২০। সে কি বসে থাকতে পেরেছিল ঘরে! যে মাটিতে তার জন্ম, সেই মাতৃভূমিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে পাকিস্তানী হায়েনারা। রুমি বসে থাকতে পারেনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। আর সেটাই তার অপরাধ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে সে। তার পরিণতি কি হয়েছিল তা আজও রয়ে গেছে অজানা। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টের পর রুমিকে কোথাও দেখা গেছে বলে কেউ জানাতে পারেনি। সুরকার আলতাফ মাহমুদ। ভাষা আন্দোলনের সেই বিখ্যাত গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...গানের সুর করেছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে তিনি দিয়েছিলেন অমর সুর আর মুক্তিযুদ্ধে বাজি রাখেন জীবনকে। দেশ মাতৃকার টানে জীবনকে করেন তুচ্ছ। ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন সুরকার আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের গেরিলাদের জন্য এক দুর্গ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল তার বাড়িটি। এ সময়ই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকা শহরে কতগুলো অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে। তাদের কাছে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় সেগুলো নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। আলতাফ মাহমুদ নিজ দায়িত্বে সব গোলাবারুদ তার বাসায় কাঁঠাল গাছের নিচে পুঁতে রাখেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে ক্র্যাক প্লাটুনের সামাদ নামে একজন গেরিলা ধরা পড়েন। পাঞ্জাবী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদকে ওই ট্রাঙ্ক ভর্তি অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল মুক্তিকামী বাঙালী জাতির ওপর। ওই সময় পাক হানাদার বাহিনীসহ রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হিংস্র থাবার বলি হয়েছেন অনেকেই। পাকিস্তানী সৈন্যদের চেয়ে বড় নরপশুর রূপ ধারণ করেছিল আমাদের দেশেরই কিছু তাঁবেদার। একাত্তর সালের যুদ্ধের সেই নয় মাসের প্রতিটি দিনেই ঝরেছে বাঙালীর তাজা প্রাণ। তবে দিন যত গড়িয়েছে তত বেড়েছে পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনের মাত্রা। একাত্তরের তেমনি একটি নির্যাতনের স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল। তিনি ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টের একটি নির্মম নির্যাতনের ঘটনার সাক্ষী দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে। ওই ঘটনার অন্যতম হোতা ছিলেন আলবদর কমান্ডার মুজাহিদ। সেই দিনই তিনিই সর্বশেষ শহীদ রুমি, বদি, আলতাফ মাহমুদকে দেখেছিলেন মুজাহিদের নির্যাতন কেন্দ্রে। এর পর এদের আর কোন দিন দেখা যায়নি। জালাল বলেন, ৩০ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় একটি বাসের শব্দ কানে ভেসে এলো। আর্মির জুতার খট খট শব্দে আমার রুমের সামনে কিছু পাকিস্তানী সেনা এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্দীরুমে আট দশ জন লোককে কুঁজো অবস্থায় ঢুকাল। তাদের দিকে চোখ ফেরাতেই আমি চমকে উঠলাম। আমি বোবার মতো হয়ে গেলাম। দেখলাম, ওই ৮/১০ জন লোক সবাই মুক্তিযোদ্ধা, যাদের সঙ্গে আমি মতিনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে বদি, জুয়েল, আজাদ, রুমী ভাইকে দেখতে পেলাম। পাশে আরেকজন ছিলেন, যার নাম আলতাফ মাহমুদ, যিনি একুশে ফেব্রুয়ারি গানের সুরকার। সবার চেহারা ছিল বীভৎস, ক্ষত-বিক্ষত। বদি ভাইকে দেখলাম, তার দু’হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে এবং তার পুরো চেহারা আঘাতে ফুলে উঠেছে। কোনভাবেই তিনি কোমর সোজা করতে পারছিলেন না। আজাদ ভাইয়েরও আঙুল কেটে নিয়েছিল এবং তার বাম কানে তখনও রক্ত জমে ছিল। তিনি আরও বলেন, দেখলাম, বদি ভাইয়ের ডান চোখ কমলার মতো ফুলে উঠেছে, চোখের মণি দেখা যাচ্ছিল না। তার বাম হাতও ফোলা ছিল, তারও আঙুল কেটে ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। আলতাফ মাহমুদের ঠোঁট দুটো পুরো শসার মতো ফুলানো ছিল। তারও ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। জুয়েল ভাইয়ের কাছে বসার সময় দেখলাম তার দু’হাতের আঙুল নেই। তারও বাম দিকের কানের নিচে জমাট রক্ত ছিল। জুয়েল ভাই আমাকে দেখে বলছিলেন, তোকেও যখন ওরা টর্চার করবে, তখন কারও নাম বলবি না। জুয়েল ভাই আরও বললেন, এমপি হোস্টেলের পাকের ঘরে ফ্যানের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে প্রথমে হান্টার দিয়ে পিটাত। তারপর মুখের ওপর গামছা বিছিয়ে গরম পানি ঢালত, পাছুপথে প্লাস্টিক পাইপ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে টর্চার করত। বুদ্ধিজীবী হত্যা : মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। কিলিং স্কোয়াড এ বাহিনীর মূল দায়িত্ব পেয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অপকর্ম শুরু করেন মুজাহিদ। এদিকে সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পরাজিত হতে শুরু করলে তিনি তার কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করেন। তিনি মুক্তিকামী সাধারণ বাংলাদেশী জনগণের পরিবর্তে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা শুরু করেন। তিনি এবং তার দল ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহকারীর ভূমিকা পালন করেন। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘেরাওকাজে মুজাহিদ ছিলেন অন্যতম নেতা। বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে- সেজন্যই এ দেশকে মেধাশূন্য করাতে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেন মুজাহিদসহ হাইকমান্ড। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরাসরি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা হাইকমান্ডের নির্দেশে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করে। মঙ্গলবার বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়েই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ- বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দু’টি অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। যাদের হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল মুজাহিদরা। তাদের হত্যার দায়ে আজ যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের জন্য প্রস্তুত ফাঁসির কাষ্ঠ। এসব স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিল জাতি। আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর হলেও বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে বাংলাদেশের আপীল বিভাগ মৃত্যুদ- বহাল রাখল। এর ভিতর দিয়ে আসলে কোন একজন হত্যাকারীর ফাঁসির আদেশ পেল না জাতি। জাতি যেন কিছুটা হলেও সেই ঋণ শোধ করল- যা রবীন্দ্রনাথেরভাষায় ভাষায়- বীরের এ রক্ত স্রোত, মাতার এ অশ্রু ধারা/ এর যত মূল্য সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা... বিশ্বের ভা-ারি শুধিবে না এত ঋণ?/রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে দিন।
×