ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী হত্যায় আপীল বিভাগের প্রথম রায়;###;সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত;###;পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর রিভিউ আবেদনের জন্য সময় ১৫ দিন

বদর কমান্ডার মুজাহিদের আপীল নাকচ, চূড়ান্ত রায় ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যায় ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ জুন ২০১৫

বদর কমান্ডার মুজাহিদের আপীল নাকচ, চূড়ান্ত রায় ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যায় ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্র্তৃক মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপীল খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার সকালে পিনপতন নীরবতার মধ্যে সংক্ষিপ্তাকারে মাত্র দুই মিনিটে এ রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বুদ্ধিজীবী হত্যায় এটাই আপীল বিভাগের প্রথম রায়। আর আপীল বিভাগের এটা চতুর্থ চূড়ান্ত রায়। বর্তমানে আরও ৮টি মামলায় নয়জনের আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষ, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ও গণজাগরণ মঞ্চ সন্তোষ প্রকাশ জানিয়ে বলেছেন, একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার মাইন্ড, হত্যার ছক প্রণয়নকারী, টর্চার ও খুনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মুজাহিদের এই রায়ে কিছুটা হলেও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শহীদ পরিবারের আত্মার কিছুটা হলেও শান্তি ফিরে আসবে। অন্যদিকে মুজাহিদের ছেলে আলী আহম্মেদ মাবরুব বলেছেন, মৃত্যুদ- বহাল থাকায় ন্যায়বিচার পাননি। মুজাহিদের বড় ভাই ফরিদপুর জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির আলী আফজাল মোহম্মাদ খালেচ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে সাক্ষী সাজিয়ে জামায়াত নেতা মুজাহিদকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আমরা অবশ্যই এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করব। উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোন ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে উচ্চ আদালত তাকে মৃত্যুদ- বহাল রাখল। আপীল বিভাগ রায়ে অভিযোগ-১ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আসামি মুজাহিদকে খালাস দিয়েছে। অভিযোগ-২ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৫ বছরের সাজা বহাল রেখেছে। অভিযোগ-৫ এ বদি রুমিসহ অন্যদের হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- বহাল রেখেছে। অভিযোগ-৬ ট্রাইব্যুনালের দেয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ-৭ এ বকচর হত্যাকা-ে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন করাদ- প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ (২ ও ৪) প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগের দায় থেকে তাকে খালাস দেয়। অন্যদিকে ৫টি অভিযোগ (১, ৩, ৫, ৬, ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩ নং অভিযোগে ৫ বছর ও ৫ নং অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করে। ৬ ও ৭ নং অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। ১ নং অভিযোগটি ৬নং অভিযোগের সাথে একীভূত করায় ১ নং অভিযোগে পৃথক কোন দ- দেয়নি ট্রাইব্যুনাল। হিটলারের হিংস্রতার সঙ্গে কোন তফাত নেই ॥ রায় ঘোষণার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মুজাহিদের মৃত্যুদ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ। এই অভিযোগে তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছেন উচ্চ আদালত। আশা করছি শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ রায় পাব। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদ- কার্যকর করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলেও জানান তিনি। মুজাহিদ আলবদর নেতা ছিলেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুজাহিদকে আলবদর নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর নেই যেখানে নিজেরা নিজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিধন করেছে। আলবদররা যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে, সে সব বুদ্ধিজীবীকে আর কখনোই আমরা ফিরে পাব না, তবে সান্ত¡না এটাই যে, অপরাধীদের শাস্তি হয়েছে। আজকের এই শাস্তির ফলে কমপক্ষে সকল বুদ্ধিজীবী খুশি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আলবদররা যে ক্ষতি করেছে তা এক শতাব্দীতেও পূরণ হবে না। তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা করেছে। ‘হিটলারের হিংস্রতা এবং আলবদরদের হিংস্রতার মধ্যে আমি কোন তফাত দেখি না’। তিনি আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় আপীল বিভাগের এটিই প্রথম রায়। শ্রম আপীলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুল হুদা বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বলতে পারি, এই বিচারের মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শহীদ পরিবারের আত্মার কিছুটা হলেও শান্তি ফিরে আসেছে । আমি এই রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি মনে করি রায়ে ইতিহাসের সত্য প্রমাণিত হয়েছে। জাতি কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে। এই মামলার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল থাকায় আমরা খুশি। পূর্ণাঙ্গ রায় পাবার পর তা বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে নগ্ন অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, অন্যান্য হত্যাকা-সহ নারকীয় অপরাধ জনক কর্মকা-ের হোতাদের বিচার না হওয়া ছিল গোটা জাতির জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। শুধু বিচার না হওয়াই নয়, এই অপরাধকারীদের রাজনীতি পুনর্বাসন করা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে তাদের মন্ত্রী করাসহ অপরাপর বিষয় ছিল ইতিহাসের আরও ঘৃণিত অধ্যায়। সেই কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদিচ্ছায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও চলমান থাকার বিষয়টি ইতিহাসের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কে অমর করে রাখবে। মুজাহিদের রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির কপালে থাকা কলঙ্ক মুছে যাওয়াসহ বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এলো। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ‘পূর্ণতার দিকে’ অগ্রসর হওয়াকে বাংলাদেশের ‘সভ্যতার দিকে’ এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি রায়ের মাধ্যমে আমরা ধাপে ধাপে সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ‘আমাদের দেয়া তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে আলবদর প্রধান হিসেবে মুজাহিদের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। তার যে জঘন্য নিষ্ঠুর ভূমিকা রয়েছে সেটি প্রমাণিত হয়েছে। ‘শুধু সাক্ষীর মাধ্যমে নয়, আলবদরের বইয়ে তার (মুজাহিদের) যে ভাষণ রয়েছে, সব কিছুর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালে যেভাবে তিনি আলবদর কমান্ডার হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন, আজ তার ভূমিকা উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।” এদিকে মুজাহিদের বড় ভাই ফরিদপুর জামায়াতে নায়েবে আমির আলী আফজাল মোহম্মাদ খালেচ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে সাক্ষী সাজিয়ে জামায়াত নেতা মুজাহিদকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। সাজানো সাক্ষী দিয়ে নাটক সাজিয়ে আমার ভাইকে সাজা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন যেহেতু ট্রাইব্যুনালে আমরা জাস্টিজ পাইনি, সে কারণে আপীল বিভাগে এসেছিলাম। আশা করেছিলাম আমরা ন্যায়বিচার পাব। কিন্তু আজকে যে রায় হলো তাতে আমরা ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা সংক্ষুব্ধ। বুদ্ধিজীবী হত্যায় মৃত্যুদ- বহাল ॥ আপীল বিভাগ মুজাহিদের আপীল খারিজ করে ৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রেখেছে। ৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত উর্ধতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র মাধ্যমে আসামি আলী আহসান মোহামদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানেরসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়নে ইত্যাদিসহ যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন। যে অভিযোগে খালাস ॥ এক নম্বর অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে হত্যার দায় থেকে আপীল মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ফাঁসির দ-াদেশ দিয়েছিল। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। আসামির পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ অবধি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। যাবজ্জীবন কারাদ- ॥ সাত নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার দায়ে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। সাত নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্যরঞ্জন দাশ, নিরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের গণহত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। আলাদা করে রায় ॥ এক নম্বর অভিযোগকে ৬ এর সঙ্গে সংযুক্ত করে এ দু’টি অভিযোগে সমন্বিতভাবে ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। আপীল বিভাগ ১ ও ৬ নম্বর অভিযোগকে আলাদা করেই চূড়ান্ত রায়টি দিল। যে দ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ ॥ পাঁচ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদ-াদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। প্রমাণিত না হওয়া ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে খালাস পান মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একমত হয়ে এ চার অভিযোগের দ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যার অভিযোগ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার মোঃ আবু ইউসুফ পাখিকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর রিভিউ ॥ সংক্ষিপ্তাকারে দেয়া এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন মুজাহিদ। ইতোমধ্যে তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর তারা রিভিউ করবেন। তিনি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে এ রায় দেয়া হয়েছে। কাজেই এখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরই আমরা রিভিউ করব। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ॥ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় একই বছরের ২১ জুলাই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট গ্রেফতার দেখানো হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ ২০১১ সালের ৩০ নবেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের আবেদন করা হয়। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২ এ স্থানান্তর করা হয়। ২০১৩ সালের ৬ মে প্রসিকিউশন পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু করেন। পরে একই বছরের ২২ মে আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৩ সালের ৫ জুন রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়। সিএভি রাখার ৪৩ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় প্রদান করা হয়। আপীল কার্যক্রম ॥ ১৮ মে রাষ্ট্রপক্ষে আংশিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল এবং ৪, ৫, ৬, ১৭ ও ১৮ মে আপিলে পেপারবুক পড়া শেষ করেন মুজাহিদের আইনজীবী। গত ১৫ এপ্রিল আপীল বিভাগ আপীলের ওপর শুনানির জন্য ২৮ এপ্রিল দিন ধার্য করে। তবে ঐদিন সিটি কর্পোরেশন নিবাচন উপলক্ষে সাধারণ ছুটি থাকায় শুনানি হয়নি। প্রায় ২১ মাস পর ২৯ এপ্রিল আপীলের ওপর শুনানি শুুরু হয়। এরপর ৪, ৫, ৬ ও ১৭, ১৮, ২৫, ২৬ ও ২৭ মে শুনানি গ্রহণ করে আদালত। ২৭ মে উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১৬ জুন দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সব শেষে ১৬ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগ মৃত্যুদ- বহাল রেখে রায় প্রদান করেন। বদর নেতা থেকে মন্ত্রী ॥ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। তার পিতার নাম মৃত মাওলানা আব্দুল আলী। মাতা-মৃত বেগম নুরজাহান। জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৪৮। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানাধীন পশ্চিম খাবাসপুর। ঢাকার ঠিকানা-রোড নং-১০, বাসা নং-০৫, ফ্ল্যাট-২/এ, সেক্টর-১১, থানাÑউত্তরা, ঢাকা। মুজাহিদ ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যয়নকালে এইচএসসি পরীক্ষা শেষের দিকে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮-১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে ডিসেম্বরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মনোনীত হন। ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। এছাড়াও মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে অনেকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট মুজাহিদ পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুস এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নুরুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে জনৈক মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মোস্তফা আল-মাদানীর মৃত্যুর জন্য কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারীকে দায়ী করে বলেন, দুষ্কৃতকারীদেরকে এর পরিণাম ফল ভুগতেই হবে। উক্ত রূপ বক্তব্যের মাধ্যমে মুজাহিদ হানাদার দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধকারীদের দুষ্কৃতকারী উল্লেখে তাদের পরিণাম ফল ভুগতেই হবে বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে মুক্তিকামী বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের প্ররোচনা দেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার নেতৃত্বে ও নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্যসহ ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা উক্তরূপ বাহিনী গঠন করে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীদের আটক, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও গণহত্যাসহ নানান ধরনের অপরাধ ব্যাপকভাবে অব্যাহত রাখে। আপীল বিভাগের চতুর্থ রায় ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে এটি আপীল বিভাগের চতুর্থ রায়। এর আগে আরো তিনটি মামলার আপীল নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা (মৃত্যুদ- কার্যকর), নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (আমৃত্যু কারাদ-) ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ- কার্যকর)। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি। আর আপীলে থাকা অবস্থাতেই জামায়াত সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বর্তমানে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলীসহ আরও ৭টি মামলা আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় যারা ॥ মুজাহিদের রায় ঘোষণার পর বর্তমানে আপীল বিভগে আরও ৮টি মামলায় ৯ জনের আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলী, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোবারক হোসেন, জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মাহিদুর রহমান এবং আফসার হোসেন চুটু। মঙ্গলবার থেকে সাকা চৌধুরীর আপীল শুনানি শুরু হয়েছে।
×