ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচার রোধে-

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৭ জুন ২০১৫

মানবপাচার রোধে-

মানবপাচারের ক্ষেত্র তৈরি এবং তার ক্রমবর্ধমান বিকাশে মিয়ানমারের অবদানটাই বেশি। তারা একটি জাতি তথা সম্প্রদায়কে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর মানবপাচার বেড়েছে। দেশত্যাগী মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝাস্বরূপ, দুর্নামের কলঙ্কের ভাগীদার। শরণার্থী হয়ে এরা দীর্ঘদিন বাংলাদেশের উপকূলীয় কক্সবাজারে বসবাস করে আসছে। ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত যতজন রোহিঙ্গা রয়েছে তার শতগুণ বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অন্যত্র। নৃতাত্ত্বিক কারণে এরা চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার জানে। ফলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্য দেশে পাড়ি দেয়। সেখানে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়লে দুর্নাম বর্তায় বাংলাদেশের ওপর। এই শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার কোন উদ্যোগ নেই মিয়ানমারের। বরং রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক নয় বলে উচ্চৈঃস্বরে বলে বেড়ায় সে দেশের সামরিক জান্তাশাসক। আর রোহিঙ্গাদের তারা ঠেলে পাঠিয়েছে জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশে। দেশহীন, সহায়-সম্বলহীন এই রোহিঙ্গারা তাই মানবপাচারকারীদের প্রধান পণ্য। একটু ঠাঁই আর দু’বেলা দু’মুঠোর প্রত্যাশায় রোহিঙ্গারা নৌকা, ট্রলারে সপরিবারে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। তাদের কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় গড়ে উঠেছে মানবপাচারকারীদের বিশাল নেটওয়ার্ট। যার সঙ্গে থাই, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার সেনা কর্মকর্তারাও জড়িত। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে দালালচক্র। নানা প্রলোভন, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মানবপাচার চলছিল। এই পাচার বন্ধের উপায় খুঁজতে থাইল্যান্ডে ১৭টি দেশ বৈঠক করেও সমাধানের কোন পন্থা আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ, মানবপাচার হচ্ছে যে দেশের বেশি, সেই মিয়ানমার তার নাগরিক রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোন দায়-দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশের পর পাচার রোধে অগ্রগতি হয়নি। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপ সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের তাদের ভূমিতে বসবাস করতে দিতে চাইছে না মিয়ানমার। তাদের কারণেই মানবপাচার নামক মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবসা চলছে। তবে মানবপাচারসহ অবৈধ কর্মকা- বন্ধে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে বান্দরবান পর্যন্ত বিস্তৃত সীমান্ত ও নাফ নদী এবং সাগরপথে মানবপাচার, মাদকসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দু’দেশের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আলোচনার পর স্পষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশী মোবাইল কোম্পানির সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত টাওয়ারের কারণে রাখাইন প্রদেশে এদেশী সিম ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে চলছে মোবিক্যাশ পদ্ধতি। এতে করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে, হচ্ছে। পাচারকারীরা এই মোবিক্যাশের মাধ্যমে পণের টাকা আদায় করে আসছে। সরকারী প্রশাসনের অবহেলা কিংবা যোগসাজশে এসব চলছে। মানবপাচারের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিক এবং প্রভাবশালীরা জড়িত না থাকলে বছরের পর বছর মানবপাচার হয়ে যাচ্ছে, পণের টাকা শোধ করতে হচ্ছে, অথচ তারা কিছুই জানে না, তা তো নয়। মানবপাচারকারী দালালদের হদিস মিলছে না। পাচার সিন্ডিকেটের হোতা দু’একজন গ্রেফতার বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, কিন্তু বিশাল নেটওয়ার্কের সন্ধান মিলছে না। রোহিঙ্গারা গত ৮শ’ বছর ধরে মিয়ানমারের অংশ হয়ে রয়েছে। আরাকান প্রদেশ ছিল চট্টগ্রামেরই অংশ। ব্রিটিশরা তাকে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত করে সমস্যা বাড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপে জর্জরিত বাংলাদেশ কক্সবাজার উদ্বাস্তু শিবির থেকে ৩২ হাজার রোহিঙ্গাকে হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তর করছে। সেখানে একটি থানা, ফাঁড়ি, হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এতে পাচার হয়ত কমবে না। তবে কক্সবাজারের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। হাতিয়া থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এই চরটি আট বছর আগে জেগে উঠেছে। মানবপাচার রোধ করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও দেশত্যাগ বন্ধ করা। তাই বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর উচিত মিয়ানমারকে স্বাভাবিক পথে চলার জন্য বাধ্য করা।
×