ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নৃত্যগীত আর কবিতার ছন্দে নগরীতে বর্ষা আবাহন

মেঘমল্লারে সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৬ জুন ২০১৫

মেঘমল্লারে সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান

মনোয়ার হোসেন ॥ বিদায় নিল জ্যৈষ্ঠের খরতাপ। এলো প্রশান্তির পরশমাখা আষাঢ়। আর শুধু আগমনী বার্তাতেই থেমে রইল না, ঝরিয়ে দিল আকাশের জলধারা। সেই কাক্সিক্ষত বারিধারায় সিক্ত হলো নাগরিক মন। হৃদয়ে বয়ে গেল বৃষ্টিভেজা আনন্দধারা। প্রকৃতির মাঝে সঞ্চারিত হলো প্রাণের প্রবাহ। জলের ধারায় ঝলমল করে উঠল পত্রপল্লব, বৃক্ষরাজি। প্রকৃতির খেয়ালে এমনটাই ঘটে গেল সোমবার রূপময় ঋতু বর্ষার প্রথম দিন। দিনটি ছিল বর্ষা ঋতুর প্রথমতম দিন পয়লা আষাঢ়। সকালেই এক পশলা রিমঝিম বৃষ্টি জানান দিয়েছে বর্ষার জয়ধ্বনি। দিনভর বিরাজ করেছে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরির খেলা। আর ঐশ্বর্যময় ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ঋতুটিকে বরণ করতে সকাল থেকেই সরব হয়ে ওঠে রাজধানী। বর্ষার আবাহনে গাওয়া হয়েছে আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যেন মন লাগে না/এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উ™£ান্ত মেঘে মন চায় মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে/মেঘমল্লারে সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান। কিংবা শহরে ভেসে বেড়িয়েছে মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে, নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ-সঙ্গীতে, রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম... গানের সুর। সকাল থেকে রাত অবধি গানের সুরে, কবিতার ছন্দে অথবা নৃত্যের ঝঙ্কারে আবাহন করা হলো সৌন্দর্যের স্মারক ঋতু বর্ষাকে। সঙ্গে ছিল বিশিষ্টজনদের আলাপচারিতায় বর্ষাকথন। তৃষিত হৃদয়ে নতুন প্রাণের গানের সুরে গাওয়া হয় বর্ষা বন্দনা। সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। অন্যদিকে সকাল সাতটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসবের আয়োজন করে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। সকাল ও বিকেল দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় এই সংগঠনটির বর্ষাবরণ আয়োজন। বর্ষা আবাহনে সকালের ঘুম কাটিয়ে সমাগম ঘটেছিল উৎসব অনুরাগী ও শেকড়সন্ধানী সংস্কৃতিপ্রেমীদের। রাঙানো মননের সঙ্গে সকলের পরনেও ছিল বর্ষাবরণের সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক। আকাশী-নীল শাড়ির সঙ্গে খোঁপায় বেলী ফুলের মালা আর হাতে জুড়ে গিয়েছিল বাদল দিনের কদম ফুল। বর্ষা উদ্্যাপনে আসা নারীরা যেন হয়ে উঠেছিল বর্ষারানী! পুরুষ কিংবা ছেলেরাও ছিল না পিছিয়ে। নীল পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়িয়েছেন ক্যাম্পাসজুড়ে। অনেকে আবার বর্ষা আশ্রিত কবিতার চরণ কিংবা ছবি সংবলিত টি-শার্ট পরেও দিনটিকে পার করেছেন। সবুজ বাঁচানোর আহ্বান জানিয়ে প্রিয়াংকা গোপের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরে সূচনা হয় উদীচীর বর্ষা উৎসব। সুর ও স্বরের খেলায় এই শিল্পী পরিবেশন করে মিয়া কি মল্লার রাগ। উপস্থিত শ্রোতাদের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেন স্নিগ্ধতার অপার অনুভূতি। এরপর সমবেত সঙ্গীত নিয়ে মঞ্চে আসে পঞ্চভাস্কর। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায় ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে বরষে’ ও ‘অম্বরে মেঘ মৃদঙ্গ বাজে’ গান দুটি। সম্মেলক সঙ্গীত শেষে সালমা আকবর ও মাহমুদ সেলিম পরিবেশন করেন একক কণ্ঠের গান। শিল্পী যুগলের কণ্ঠে গীত হয় ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ ও ‘রিমঝিম রিমঝিম’। গান শেষে গুঞ্জরিত হয় ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি। কবিতার শিল্পিত উচ্চারণের পর বর্ষা আবাহনে যোগ দিয়ে বিশেষ গীতি আলেখ্য পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এ গীতি আলেখ্যের মূল ভাবনা ছিল ‘সবুজ বাঁচাই, সবুজে বাঁচি’। টানা দশম বছরের মতো আয়োজিত উদীচীর বর্ষা উৎসবে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা এবং উস্তাদ মমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমির শিল্পীরা। সুরের শব্দধ্বনি ছড়িয়ে একক কণ্ঠে গান শোনান সাজেদ আকবর, ছায়া কর্মকার, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, মহাদেব ঘোষ, সোহানা আহমেদ প্রমুখ। সাংস্কৃতিক পর্ব শেষে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষাকথন। এতে অংশ নেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ দ্বিজেন শর্মা, কৃষিবিদ ও উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। আর উদীচীর পক্ষ থেকে বর্ষার ঘোষণা পাঠ করেন ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান ইকবাল। তবে বর্ষাকথন শুরুর পরপরই আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি নামে অনুষ্ঠানস্থলে। এ বৃষ্টি যেন বর্ষা উৎসবের মূল লক্ষ্যকেই সার্থক করে তোলে। বৃষ্টিতে ভিজেই বর্ষা কথন অংশটি শেষ করার পরপরই পুরো অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়। ছাতা মাথায় ধরে বর্ষাকথনে অংশ নেন কামাল লোহানী। বলেন, বর্ষা এলে রাস্তাঘাট ডুবে যায় কখনও কখনও। কিন্তু আজকাল রাজধানী শহর সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায় কারণ পাড়া মহল্লায় যে ডোবা পুকুরগুলো ছিল, তা ভরাট করে বহুতল ভবন উঠেছে। জল নিকানোর ব্যবস্থাও তেমন নেই। তো ঐ বর্ষণ যাবে কোথায়, জমে রাস্তায়। জনগণের দুর্ভোগ বাড়ায়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে তাই তাপপ্রবাহ কমে তো নাই বরঞ্চ বেড়ে যায় নিদারুণ। আমরা শহরে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান করি। আনন্দে-উল্লাসে যে বর্ষা নিয়ে সাহিত্য হবে, সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে তাও তো দেখা পাই না। তাই ঐতিহ্য সচেতন হতে হবে আমাদের। এছাড়া সোমবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঘনদেয়া বরিষে’ শীর্ষক বর্ষার গানের বিশেষ অনুষ্ঠান। বর্ষার সুরাশ্রিত এ সঙ্গীতসন্ধ্যার আয়োজন করে বাংলার মুখ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বর্ষা আবাহনে অনুষ্ঠিত হবে আরও কিছু উৎসব। সেই সূত্রে জুলাই মাসে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে ছায়ানট। ধানম-ির নিজস্ব ভবনে ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য বর্ষা উৎসবে থাকবে সঙ্গীত ও নৃত্যসহ অন্যান্য আয়োজন।
×