ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র হক

আষাঢ়ের ঝর ঝর প্রথম দিনে কালো মেঘের ছোঁয়া হৃদয়ে হৃদয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৬ জুন ২০১৫

আষাঢ়ের ঝর ঝর প্রথম দিনে কালো মেঘের ছোঁয়া হৃদয়ে হৃদয়ে

বর্ষার রোমান্টিকতা শুরু হয়েই গেল। দিন কয়েক আগে কী দাবদাহ, আকাশের কালো মেঘ শীতল করে দিল বারিধারা ঝরিয়ে। বর্ষা কতটা মধুর-বেদনার আর কতটাই বা রোমান্টিকতা! সেই বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাঙালীর ঋতু বন্দনায় কতই না বর্ণনা এসেছে। সব ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতিতে মানব-মানবীর হৃদয়ের আবেগের ধারা তৈরি করেছেন। যেখানে অকারণে চোখের জলও ভাললাগার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলা কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীতে বর্ষাকে নিয়ে যত গান, যত কবিতা, যত গল্প, যত উপন্যাস, যত রোমান্টিকতা অন্য কোন ঋতুকে নিয়ে এতটা নেই। বর্ষার প্রথম দিনের নবধারা জলের স্থানে অবগাহনে যে আবেগ হৃদয়ে গেঁথে যায়, তা পুঞ্জীভূতই হয়ে থাকে। বর্ষার এই ধারায় গীতিকারদের কথায় কতই না সুর উঠেছে। সতীনাথের কণ্ঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিম ঝিমরিম ঝিমঝিম গান গেয়ে যাই...’, মান্না দে’র কণ্ঠে ‘ওগো বরষা তুমি ঝরো নাকো এমন করে...।’ গানে প্রেমিকার পথ চেয়ে বসে থাকা প্রেমিক বৃষ্টিকে না আসার আহ্বান জানিয়ে বলে, প্রেমিকা কাছে এলে যেন অঝর ধারায় ঝরে, যেন যেতে চেয়েও যেতে না পারে। হেমন্তের কণ্ঠে ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো...’ গানের ছন্দে কতই না মধুময়তা। লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘আষাঢ় শ্রাবণ, মানে না তো মন, ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে, তোমাকে আমার মনে পড়েছে’, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষা হাওয়া, হিম হিম হিম পরসা তুমি এলে আজ মনে সহসা পথ চলিতে যে তাই ভরসা...’ গানে হৃদয়বীণায় কত আকুতি জেগে উঠে। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষারও প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয় সেদিন তাহার সাথে কর পরিচয়, কাছে কাছে থেকেও যে তবু কাছে নয়...’ গানে রোমান্টিক ছন্দে বৃষ্টির শব্দে প্রেমিক যায় এগিয়ে। আধুনিক গানের এই ধারার বহু আগে বর্ষার কাব্যধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ীদাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতাকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও এগিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন হৃদয়ের রঙে। মেঘ তো পালা করে এসে খেলা করে। বর্ষায় আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্ণের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুষ্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। মেঘের আরেক পারেই রঙধনু। সেই রঙের মধ্যেই এনেছেন প্রেয়সীর মিলনের ব্যাকুলতা, যেখানে মেঘ মাদলের সুরে রাধার মনে পড়ে কৃষ্ণকে। সেই আবেগে বৃষ্টিতে ভিজে তমালকুঞ্জের ভেতর দিয়ে ছুটে যায় নীপবনে কৃষ্ণের কাছে। রাধার আবেগের গতি যেন বৃষ্টির ধারাকে তুচ্ছ করে দেয়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ প্রেমব্যাকুল নারীর প্রেমিকের কাছে ছুটে যাওয়াকে কত অন্তরঙ্গ করে দেখেছেন। তাঁর গানে এসেছে ‘এসো শ্যামল সুন্দর আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে...’। কালিদাসের বর্ণনায় রেবা নদীর তীরে বর্ষার দিনে মালবিকা প্রতীক্ষায় ছিল প্রিয়তম আসবে বলে। বাংলার আকাশে যেভাবেই বর্ষা আসুক, তার সত্ত্বা ঘিরে আছে বাস্তবতায় মানুষের জেগে উঠার সংগ্রামের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করার আহ্বান। এর মধ্যেই হলুদ বরণ গায়ক দল হেরে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তুলে বর্ষার বারতাই জানিয়ে দেয়। ব্যাঙ গোষ্ঠীর ব্যান্ড দল কোলা ব্যাঙ জলাশয়ে নেমে পড়ে। বর্ষা মৌসুমের সুর সাধা ব্যাঙকে নিয়ে কতই না কথা! অন্তরা চৌধুরীর গানে ‘ও কোলা ব্যাঙ, ও সোনা ব্যাঙ, সারারাত হেরে গলায় ডাকিস ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ... তোরা কি গলা সাধিস নে... তোরা কি নাড়া ভাজিস নে...’ শিশুদের (বড়দেরও) এই গান আনন্দ দেয়। এই সময়েই নদ-নদী ফুলে ফেঁপে রুদ্ররূপ ধারণ করলে নদী তীর ও চরগ্রামের মানুষ জেগে উঠে নিজেদের রক্ষায়। মাটির বাঁধও যখন রক্ষা করতে পারে না, তখন মানবজীবনের সঙ্গে পশুপাখির জীবন রক্ষার তাগিদও মানবিক গুণাবলীতে যোগ হয়। কে আপন, কে পর তা মুছে যায়। স্রোতের তীব্র ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৌকার বৈঠা ঠেলে পাড়ি দেয় শুকনো ভূমির আশ্রয়ে। ভালবাসার বন্ধনে একাকার হয়ে যায় মানুষ। বর্ষার সজল মেঘের গভীর কালোয় এক অরুণ আলোর দেখা পায় মানুষ। না বলা এ কথাগুলো বর্ষার আলাদা সুরে এসেছে নিবিড় অনুভবে। বেদনার্ত এমন আলেখ্যের মধ্যেই মানুষ নিজেদের ছন্দেই এগিয়ে যায়। এবার আষাঢ়ের শুরুতেই বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। বর্ষায় অনুষঙ্গ যাই থাক, বৃষ্টির সুর মানব-মানবীর হৃদয়ে আরেক সুর এনে দেয়, যা মধুছন্দে নেচে উঠে। গ্রামে টিনের চালা ঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ধ্রুপদী সুর তোলে। বৃষ্টিতে ভিজে এবং ছাতা নিয়ে বেড়ানো সে আরেক ছন্দ। তরুণ আর শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস মাতিয়ে দেয় বর্ষাকে। কিশোর-কিশোরী হাঁটু পানি পেরিয়ে যায় এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। গ্রামীণ জীবনে বর্ষার এমন ধারার মধ্যে মানুষ খুঁজে নেয় জীবনের অর্থ। বর্ষায় জলে ভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। গ্রামের ঝাউবনে, বাঁশ বাগানে, নদী তীরে চর এলাকায় বর্ষায় ফোটে নাম না জানা কত বনফুল, যা মন রাঙিয়ে দেয়। বাঙালী সংস্কৃতিতে বর্ষার প্রতীকী ফুল কদম। ‘বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল করেছ দান...’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী ভেবে কদমকে এভাবে টেনে এনেছেন তার ব্যঞ্জনা তিনিই দিয়েছেন গানের সুরে। বর্ষায় শহুরে জীবন আবার আরেক ধারার। বড় বড় শহরে বৃষ্টি এনে দেয় যন্ত্রণা আর দুর্ভোগ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বৃষ্টি হলেই ভোগান্তির মাত্রা যায় বেড়ে। খ-কালীন বন্যার রূপ নেয় মহানগরী। স্তব্ধ হয়ে পড়ে সবকিছুই। একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম বন্ধুর পথের মতো। তবুও থেমে থাকে না জীবন। বর্ষার এমন জীবনেই মানুষের পথচলা।
×