ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে কয়েক শ’ গ্রাম পানির নিচে ॥ ত্রাণ পৌঁছেনি, খাদ্য সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৬ জুন ২০১৫

কুড়িগ্রামে কয়েক শ’ গ্রাম পানির নিচে ॥ ত্রাণ পৌঁছেনি, খাদ্য সঙ্কট

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। একাধিক নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আবার কয়েক নদীর পানি কমলেও এখনও এসব এলাকায় ত্রাণ না পৌঁছানোয় মানবেতর জীবন-যাপন করছে বানভাসিরা। হাজার হাজার হেক্টর জমির আমন বীজতলা, সবজি ক্ষেত ও পাটসহ বিভিন্ন ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রামের তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদীর তীরবর্তী তিন শতাধিক গ্রাম গত ৬ দিন ধরে পানির নিচে রয়েছে। ফলে এসব এলাকার শতাধিক মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বন্যায় এসব এলাকার দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। অনেকে ঘরের মধ্যে উঁচু মাচা তৈরি করে বাস করলেও জ্বালানি, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধায় নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১৯.৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ জেলার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। যমুনা ও ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি ও টানা বর্ষণে গত চার দিনে ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর উপজেলার ৪ ইউনিয়ন এবং কালিহাতি উপজেলার ২ ইউনিয়নে নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ফলে স্কুলসহ বহু ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙ্গন কবলিত গ্রামগুলো হলো- ভূঞাপুরের গোবিন্দাসী ইউনিয়নের খানুরবাড়ি, কষ্টাপাড়া, চরচিতুলিয়া, ভালকুটিয়া ও চিতুলিয়াপাড়া। অর্জুনা ইউনিয়নের কুঠিবয়ড়া, অজুর্না, চুকাইনগর, শুশুয়া ও গোবিন্দপুর। গাবসারা ইউনিয়নের রুলীপাড়া, রেহাই গাবসারা, রামপুর, চ-িপুর ও মেঘারপটল। নিকরাইল ইউনিয়নের কোনাবাড়ি ও বাইনতাইন। কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের বেলটিয়া, শ্যামশৈল, দৈবগাতি, বিন্নোদলহুড়ি, বিয়ারামারুয়া, আলীপুর এবং দুর্গাপুর ইউনিয়নের ভৈরববাড়ী। হুমকির মুখে রয়েছে ৬ ইউনিয়নের স্কুল, কলেজ, নৌপুলিশ ফাঁড়ি, মসজিদ, মন্দির, পোল্ট্রি খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ওদিকে বগুড়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে নগরবাসী। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার। কুড়িগ্রাম ॥ বন্যায় কুড়িগ্রামে আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ৬ দিন ধরে নিমজ্জিত আছে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার তীরবর্তী তিন শতাধিক গ্রাম, চর ও দ্বীপচর। বানভাসি এসব মানুষ ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পানি কমেছে দুধকুমারে ১৫ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রে ১৩ সেন্টিমিটার ও ধরলায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি কমছে। ফলে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুরের ৪২টি ইউনিয়নের চলাঞ্চল ও নদ-নদী তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কারণে এসব এলাকার সকল গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেছে। নৌকা ছাড়া যোগাযোগের উপায় নেই এসব এলাকায়। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চরযাত্রাপুর গ্রামের আমেনা বেগম জানান, ৫ দিন ধরে ছেলে মেয়ে নিয়ে পানির মধ্যে আছি। নলকূপে পানি উঠছে না। বাইরে থেকে পানি আনি খাওয়া লাগে। নৌকা নাই, খাবার নাই। খুব কষ্টে আছি। চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চরের আনছার আলী জানান, পানির জন্য কোন দিকে বেড়াতে পারি না। নৌকা নাই, হাটবাজার যেতে পারি না। খাওয়া-দাওয়ার খুব সমস্যায় আছি। গত ৫ দিন ধরে কাজ নাই। ঘরে খাবার নাই। গরু-ছাগল নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, জেলায় বন্যা কবলিতদের জন্য ৫০ মেট্রিক টন চাউল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা দ্রত বিতরণ করা হবে। টাঙ্গাইল ॥ যমুনা ও ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি ও টানা বর্ষণের ফলে গত চারদিনে ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এসব বাস্তুহারা মানুষের কারও ঠাঁই হয়েছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কেউবা সড়কের পাশে খুপড়ি তুলে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক হুমকির মুখে রয়েছে। অথচ ভাঙ্গন রোধে কার্যকর কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেনি স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ভূঞাপুর উপজেলার অর্জুনা, গাবসারা, নিকরাইল, গোবিন্দাসী এবং কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামগুলোতে প্রমত্তা যমুনা ও ধলেশ্বরী নদী করালগ্রাসী রূপ নিয়ে হানা দিয়েছে জনপদগুলোতে। ভাঙ্গনে ইতোমধ্যে মানুষের ঘরবাড়ি ছাড়াও তাদের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গন কবলিত লোকজন তাদের ঘরবাড়ি সরানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। এদিকে অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক হুমকির মুখে পড়েছে। গত দুই বারের ভাঙ্গনে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কের যান চলাচল বন্ধ ছিল। গোবিন্দাসী ইউনিয়নের কষ্টাপাড়া গ্রামের শিক্ষক মজিদ সরকার ও আব্দুস ছবুর জানান, গেল দুই বছর ধরে যমুনা নদীতে ভাঙ্গন শুরু হলেও তা নিরসনে কার্যকর কোন প্রদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। এবার নতুন করে আবারও ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। অর্জুনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মকবুল খাঁ, সাদিক, তবু খাঁ ও বাছেদ খাঁ জানান, পুরনো জনপদ হিসেবে খ্যাত অর্জুনা গ্রামে একশ’ বছর পর যমুনা নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। লিখিত আবেদনের পরও স্থানীয় প্রশাসন ও টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে ভাঙ্গন রোধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় সম্প্রতি এই গ্রামে ভাঙ্গন ঠেকাতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। অব্যাহত ভাঙ্গন ও প্রবল বর্ষণে সে বাঁধও নদীগর্ভে চলে গেছে। এছাড়া গত বছর ভাঙ্গনরোধে ৫শ’ বস্তা জিও ব্যাগ বরাদ্দ হলেও অদৃশ্য কারণে সেগুলো না ফেলে ফেরত নেয়া হয়। ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম জানান, ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভাঙ্গন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধায় নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর এলাকার বন্যাকবলিত পানিবন্দী লোকজন বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও শুকনা খাবারের অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সোমবার ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার ১৯.৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ঘাঘট নদীর পানি বর্তমানে ২১.৬৫, করতোয়া ১৮.২৭ এবং তিস্তা নদীর পানি ২৪.৪৮ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানি বৃদ্ধির ফলে সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চর এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে ১৫ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদীর তীরবর্তী এলাকার শত শত পরিবার বন্যা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়া এলাকার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি পয়েন্টে ফাটল দেখা দেয়ায় এখনও হুমকির মুখে রয়েছে। এছাড়া সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৩২টি গ্রামজুড়েই এখন নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েছে। বগুড়া ॥ গ্রীষ্মের দাবদাহের পর আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি জনজীবনে কিছুটা স্বস্তির শীতল পরশ এনে দিলেও জলবদ্ধতা বগুড়ার নগরজীবনে আরেক বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছে। এক পশলা বৃষ্টিতেই শহরের প্রধান সড়কগুলো পানিতে ডুবে যায় সোমবার। আর সামান্য বৃষ্টিতেই জলবদ্ধতায় শহরবাসীর দুর্ভোগে নাকাল হওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিনের। জলবদ্ধতার দুর্ভোগ যেন শেষ হবার নয়। তাই এবারের বর্ষায় নগরজীবনে জলবদ্ধতার সেই দুর্ভোগ আরও বাড়ানোর আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
×