ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোজা-ঈদ সামনে রেখে বাজারে ঢুকছে জাল টাকা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৫ জুন ২০১৫

রোজা-ঈদ সামনে রেখে বাজারে ঢুকছে জাল টাকা

রহিম শেখ ॥ রোজা ও ঈদ আসার এখনও ঢের বাকি। এর আগেই বাজারে ঢুকে পড়ছে জাল টাকা। বড় উৎসব তাই রাজধানীসহ সারাদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল টাকা তৈরির একাধিক চক্র। মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে শনিবার রাতেও ৪০ লাখ জাল নোটসহ ৬ ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কোটি টাকার জাল নোট নিয়ে এসব চক্র মূলত মার্কেট, বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলো টার্গেট করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথে জাল টাকা দিতে এসব প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিছু অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাও। সবচেয়ে আঁতকে উঠার মতো বিষয়টি হচ্ছে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিন ধরতে পারে না। ফলে প্রতিটি টাকার নোট চোখে দেখে শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না অনেকের। এ কাজের সঙ্গে জড়িতরা বিভিন্ন সময়ে আটক হলেও জামিনে বেরিয়ে আবার জড়িয়ে পড়ছে একই অপরাধে। এ সংক্রান্ত মামলার জন্য পৃথক কোন আদালত না থাকায় মামলাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না সহসাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক নোটের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শক্তিশালী করা গেলে জাল নোট তৈরি অনেকাংশেই বন্ধ হবে। এদিকে জাল টাকা প্রতিরোধে গত বছরের মতো এবারও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত নোটগুলোর মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটই বেশি পরিমাণে জাল হচ্ছে। জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম ও নোটসহ যেসব প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই ওই সব নোটের জালকারী। ৫০ ও ১০০ টাকা মূল্যমানের নোটগুলো এখন জাল হচ্ছে না বললেই চলে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাল নোটসহ গ্রেফতার করা চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ থাকলেও এক্ষেত্রে জোরালো কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয়, ওই সব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসেন না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল টাকা প্রতিরোধ কমিটির সভায় বারবার বিষয়টি তুলে ধরা হলেও নেয়া হচ্ছে না কার্র্যকর কোন উদ্যোগ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এক হাজার টাকার মতো বড় নোটই জাল হয় বেশি। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে ছাপানো এসব জাল টাকা মানুষের হাত ঘুরে চলে আসে নগদ লেনদেনের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিন ধরতে পারে না। তিনি আরও বলেন, এজন্য প্রতিটি টাকার নোট চোখে দেখে শনাক্ত করে রাখতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে অন্তত ৩৫টি চক্র খোদ রাজধানীতেই সক্রিয় রয়েছে। গত ৮ জুন রাজধানীর মিরপুরের একটি ভাড়া বাসা থেকে ছাপা ও অর্ধছাপা বাংলাদেশী ১০০০ ও ৫০০ টাকা মূল্যমানের বিপুল পরিমাণ জাল নোট, তা তৈরির কাগজ, ১২টি ফ্রেম, রং, নিরাপত্তায় ব্যবহৃত থ্রেট সুতা, ৩টি ল্যাপটপ, ১টি ডেক্সটপ কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ১২ বান্ডিল ১০০০ ও ৫০০ টাকা লেখা জলছাপ দেয়া কাগজ, ২টি কার্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এ সময় এ চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবি পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান, আটকৃতরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বেশকিছু টাকা তারা বাজারে ছেড়েছে। জানা যায়, জাল নোট চক্রের প্রধান শফিকুল তার সহযোগীদের নিয়ে ছয়-সাত বছর ধরে জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত করার পেশায় জড়িত। এর আগেও দু’বার শফিকুল পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। জামিনে বেরিয়ে আবার পুরনো পেশায় ফিরে যায়। সে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরির কারখানা স্থাপন করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা, ভারতীয় রুপী, ডলার, ইউরোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা তৈরি করে। আরও জানা যায়, জাল নোট চক্র তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জাল নোট বাজারজাত করে। তিন ধাপে এসব জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দেয়। প্রথম ধাপে জাল মুদ্রা নোট প্রস্তুতকারীরা পাইকারি বিক্রেতার কাছে এক হাজার টাকার নোটের একটি বান্ডিল (এক লাখ টাকা) ২৫-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতার কারণে জাল নোট তৈরির প্রবণতা কমেছে, তাই দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। আসল নোট চেনার সহজ উপায় ॥ সম্প্রতি জাল টাকা প্রতিরোধে আসল নোটের বৈশিষ্ট্য-সংবলিত বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান চারটি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতেÑ ১. প্রত্যেক প্রকার নোটেই মূল্যবান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা রয়েছে। নোটের মূল্যমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার ৪টি স্থানে মুদ্রিত আছে। নোট চিত করে ধরলে নিরাপত্তা সুতায় মূল্যমান এবং লোগো দেখা যাবে। কিন্তু কাত করে খাড়াভাবে ধরলে তা কালো দেখা যাবে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত বা নোটের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে উক্ত নিরাপত্তা সুতা কোনক্রমেই উঠানো সম্ভব নয়। জাল নোটের নিরাপত্তা সুতা সহজেই নখের আঁচড়ে বা মোচড়ানোতে উঠে যায়। ২. প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডানদিকে কোনায় ইংরেজী সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত রয়েছে। ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট আস্তে আস্তে নড়াচড়া করলে নোটের মূল্যমান লেখাটি সোনালী হতে ক্রমেই সবুজ রঙে পরিবর্তিত হয়। একইভাবে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোটে ৫০০ মূল্যমান লেখাটি লালচে হতে পরিবর্তিত হয়ে সবুজ হয়। জাল নোটে ব্যবহৃত এ রং চকচকে করলেও তা পরিবর্তিত হয় না। ৩. প্রত্যেক প্রকার নোটের সম্মুখ ও পশ্চাত পৃষ্ঠের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং ৭টি সমান্তরাল সরলরেখা উঁচু-নিচুভাবে (খসখসে) মুদ্রিত আছে।
×