ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা...

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৫ জুন ২০১৫

এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা...

মোরসালিন মিজান ॥ বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।/ তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।/ তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা...। ফুল ফল ফসল দিয়ে সাজানো এখন বাংলা মায়ের ডালা। কিছুদিন আগের রুক্ষতা শুষ্কতা বিদায় নিয়েছে। নতুন প্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি। মানুষের মনেও কোমলতর স্পর্শ। এসব পরিবর্তন বলে দিচ্ছে- বর্ষা এসেছে। আজ ১ আষাঢ়, ১৪২২ বঙ্গাব্দ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হবে বর্ষার। কবিগুরুর ভাষায়- এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,/গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন ভরসা...। ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয়বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ। এ বদলে যাওয়া রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন, বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ ময়ূর পেখম মেলে নাচে। বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে নজরুল লিখেছেন- রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/ কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে,/মনের বনের মুকুল খোলে/নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে...। বর্ষায় চিত্তচাঞ্চল্যের কথা জানিয়ে ভাটি বাংলার সাধকপুরুষ উকিল মুন্সি লিখেছেন- যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/ অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...। কবিগুরু লিখেছেন- মন মোর মেঘের সঙ্গী,/ উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে/রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...। রিমঝিম এ বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যতœ করে ব্যাগে পুরে রাখে রঙিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইত রূপ! মানুষের মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগায় বর্ষা। প্রেমের বোধ উস্কে দেয়। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়- তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/ কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। একই অনুভূতি থেকে নজরুল লিখেছেন- রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/ গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ ঘুমন্ত ধরা মাঝে/ জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেন- চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা...। কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! হয়ত এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়। পুরনো বিয়োগব্যথা বুকে বাজে। অভিন্ন অনুভূতির কথা জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেন- এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। হয়ত একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমন দিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ লেখেন- প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বলাটি এ রকম- বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীর- শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। কবি অন্যত্র লেখেন- অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...। এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। আলাদা করে বলতে হয়, হাওড় এলাকার কথা। বর্ষায় হাওরের চেহারা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ পায়ে হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জল নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাঁদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাটির বাউল উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেন- গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে...। বর্ষায় এ সব অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের প্রচলন আছে। নৌকো করেই বর যান বিয়ে করতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁদের কালজয়ী সৃষ্টি সে কথা বলে। অবশ্য বর্ষার সবই উপভোগ্য, উপকারের এমনটি বললে কিছু বেশি বলা হবে বৈকি। ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সে-ও বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারাবছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিম সে অবস্থা তুলে ধরে গান- আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/ বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্পতো প্রতিদিনের। তবে বর্ষায় কবিগুরুর প্রার্থনাটি এ রকম- সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...। এমন সুন্দর প্রত্যাশা পূরণে আসুক বর্ষা। বর্ষাবরণ উৎসবে মাতবে ঢাকা ॥ প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে প্রিয় ঋতুকে। রাজধানী ঢাকায় সারাদিনই থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। আজ সোমবার সকালে বাংলা একাডেমিতে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সকাল ৭টায় শাহাবুদ্দির আহমেদের বাঁশির সুরে শুরু হবে উৎসব। থাকবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। একক ও দলীয় সঙ্গীতে বর্ষা বন্দনা করবেন শিল্পীরা। থাকবে নৃত্য ও আবৃত্তির পরিবেশনা। একই সময় চারুকলার বকুলতলায় দিনভর বর্ষা বন্দনা করবে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। এখানে অনুষ্ঠানমালা চলবে সারাদিন। সকালে দোতরা ও বাঁশির সুরে স্বাগত জানানো হবে প্রিয় ঋতুকে। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবে ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমি, সুরসপ্তক, পঞ্চভাস্বর ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবে নটরাজ, স্পন্দন, নৃত্যাক্ষ ও নৃত্যম। মহাদেব ঘোষ, সালমা আকবর, আবু বকর সিদ্দিক, অনিমা রায়, ইফফাত আরা নার্গিস ও তানভীর সজীব গানে গানে বর্ণনা করবেন বর্ষার প্রকৃতি। মনের অবস্থা। এ আয়োজনেও থাকবে কবিতা। প্রিয় কবিতায় বর্ষা বন্দনা করবেন রফিকুল ইসলাম ও লায়লা আফরোজ। একই রকম আয়োজন থাকবে বিকেলে।
×