ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের ফলে জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটছে

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৪ জুন ২০১৫

অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের ফলে জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটছে

নিখিল মানখিন ॥ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে সংগৃহীত প্রায় সাড়ে ছেচল্লিশ হাজার ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্তে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের কারণে একজনের জটিল রোগ আরেকজনের শরীরে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। রক্তদান একটি মহৎ সেবা। কিন্তু অনিরাপদ রক্তই আবার মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেশের শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র অনুমোদনহীন। রক্ত সংগ্রহের সময় বাধ্যতামূলক পাঁচটি পরিসঞ্চালন সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয় না শতকরা ৫০ ভাগ কেন্দ্রে। গত দু’বছরে সারাদেশে ইতোমধ্যে দু’শতাধিক অনিরাপদ ও ভূয়া ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। জব্দ করা হয়েছে কয়েক হাজার অনিরাপদ রক্ত। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। হেলথ বুলেটিন-২০১৪ এ বলা হয়েছে, গত ২০১৩ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৪ ইউনিট রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪০ ইউনিটে এইচআইভি পজিটিভ, ৩৬ হাজার ২৯১ ইউনিটে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, ৪ হাজার ৭০৬ ইউনিটে হেপাটাইটিস সি পজিটিভ, ৩ হাজার ৯৫০ ইউনিটে সিফিলিস ও ১ হাজার ৩৪৪ ইউনিট রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা পড়ে। তবে বেসরকারী হিসাবে দূষিত রক্তের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বুলেটিনে বলা হয়, গত ২০১১ সালে ৬ হাজার ৫৪১ ইউনিট এবং ২০১২ সালে ৬ হাজার ৪৮৪ ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়। গত ২০১৩ সালে হঠাৎ করে ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত রক্তের পরিমাণ বেড়ে ৪৬ হাজার ৫৯১ ইউনিটে দাঁড়ায়, যা ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। ২০১৪ সালেও প্রায় ৪৫ হাজার ইউনিট রক্তে বিভিন্ন জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে, যা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি বলে জানা গেছে। হেলথ বুলেটিনে বলা হয়, ২০১৩ সালে সংগৃহীত ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৪ ইউনিট রক্তের মধ্যে রোগীর আত্মীয় সম্পর্কের লোকজনের কাছ থেকে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৯০ ইউনিট এবং ভল্যুান্টিয়ার উৎস থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৪ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সন্ধানী ৩ হাজার ৬২৫ ইউনিট, রেড ক্রিসেন্ট ৫৪ হাজার ৩৮৬ ইউনিট, কোয়ান্টাম ৬০ হাজার ১৫০ ইউনিট এবং বাঁধন ৬৫ হাজার ৬৫১ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান সরকার চিকিৎসার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রক্ত দান একটি মহৎ সেবা। রক্তের প্রয়োজনে জীবাণুমুক্ত নিরাপদ রক্তই রোগীকে নতুন জীবন দিতে পারে। নিরাপদ রক্ত মুর্মূষু রোগীকে দিবে নবজীবন। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এসব জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকা এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত গ্রহণ করা। সারা বিশ্বে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন গড়ে তোলা দরকার। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, প্রতি চার মাস অন্তর একজন সুস্থ ব্যক্তি রক্ত দান করতে পারে। স্বেচ্ছায় রক্তদান সর্বোত্তম সেবা। স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে বারডেমের পক্ষ থেকে একটি কোটপিন দেয়া হয়। আর দেয়া হয় ভল্যুন্টারি ডোনার কার্ড, যা রক্ত দানের ছয় মাস পর থেকে যে কোন রক্তের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিবামূল্যে আপনার প্রেরণকৃত ডোনারের জন্য সেবা প্রদানে বাধ্য থাকে। তিনি আরও বলেন, রক্তদানের আগে ডোনারদের এ্যালকোহল পান বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। রক্তদানের আধ ঘণ্টা পূর্বে চা কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। খাবার গ্রহণ করে আসতে হবে। সুস্থ ব্যক্তি আদর্শ রক্তদাতা। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হাঁপানি, জ্বর, ইত্যাদি থাকলে রক্ত দান থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি আরও জানান, রক্তদানের পর ডোনারকে তরল জাতীয় খাবার (যেমন জুস) গ্রহণ করা দরকার। প্রচুর (প্রায় তিন লিটার) পানি/পানীয় পান করা উচিত। নিতে হবে বিশ্রাম। ভারি কাজ, গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আর দুধ জাতীয় খাদ্য রক্ত দানের এক ঘণ্টা পর খেতে পারেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাঃ রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতিনিয়ত অনাকাক্সিক্ষত সড়ক দুর্ঘটনা, মায়ের প্রসবজনিত জটিলতা, ক্যান্সার, লিওকেমিয়া এবং থ্যালাসিমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর জীবন রক্ষার্থে রক্তের প্রয়োজন হয়। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এসব জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকা এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত গ্রহণ করা। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৪১টি বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের (ব্লাড ব্যাংক) সর্বশেষ তালিকা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জনসাধারণের নিরাপদ জীবনের বিষয়টি বিবেচনায় এনে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকায় বাইরে থাকা ব্লাড ব্যাংকগুলো অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সাধারণ মানুষের উচিত হবে ওই সব অবৈধ ব্লাড ব্যাংক এড়িয়ে চলা। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্লাড ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় কিনা তাও মনিটর করা হবে। দেশের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর ওপর দু’বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর করুণ অবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র।
×