ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৪ জুন ২০১৫

সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টার্গেট পূরণে আমেরিকা পৌঁছানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হলেও লন্ডন পৌঁছানো গেছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। শনিবার ‘জাতীয় বাজেট ২০১৫-১৬ পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। সেমিনারে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, লুটপাটের ক্ষতিপূরণ পোষাতে সরকার করের আওতা ও পরিমাণ বাড়াচ্ছে। উত্তরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, তিন বছর পরে আড়াই লাখ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) হবে। অন্যদিকে বিএনপির সময়ে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এডিপি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে দেখা করেননি। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন। এটা দেশের জন্য ভাল খবর বলে মন্তব্য করেন মুস্তফা কামাল। শনিবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে ‘জাতীয় বাজেট ২০১৫-১৬ পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। সিপিডি চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আলোচনায় অংশ নেনÑ অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বিএনপি সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আরাস্তু খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, এসিআইয়ের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌল্লাসহ অনেকে। মূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আদায়। কারণ চলতি অর্থবছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক জানান, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাত ভাগ অর্জন করতে অতিরিক্ত ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেসরকারী বিনিয়োগ দরকার। ওই অর্থবছরে ৯৭ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী নির্ধারণ করা হয়েছে। এটার বাস্তবায়নও সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় আমীর খসরু তাঁদের সরকারের সময়ের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সময়ে বিভিন্ন সূচকের তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় আট বছর পরও জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ সময় তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও বাংলাদেশের পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। তিনি বলেন, তাঁদের সরকারের আমলে বিভিন্ন আর্থিক খাতের সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু এখন কোন ধরনের সংস্কার কার্যক্রম না থাকায় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে গেছে। এ সময় তিনি ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করার তাগিদ দেন। আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাবে সরকারী অর্থের অপচয় হচ্ছে। সরকারী কর্মকর্তারা রাজনীতিকরণের শিকার হচ্ছে। যোগ্য কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে। এ কারণে সঠিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পুনর্মূলধন হিসাবে। আগেও কয়েকবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এ ধরনের অর্থ দেয়া হয়েছে। এসব টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। অপচয় হচ্ছে জনগণের করের টাকা। কারা এ অর্থ নিচ্ছে সরকার জানে কিন্তু বিচার হচ্ছে না। জনগণের করের টাকা থেকে এবারও পুনঃঅর্থায়নে অর্থের যোগান দেয়া হচ্ছে। লুটপাটকারীকে বিচারের আওতায় না এনে আবারও লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। একই ভাবে পুঁজিবাজারের অর্থ যারা লুটপাট করেছে তাদের বিচারও হচ্ছে না। সরকারের তদন্তে এদের নামও উঠে এসেছে। তারপরও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ৭ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য থাকলেও ধারাবাহিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য বড় অর্জন। তবে স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ত। বিএনপি নেতার প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সমালোচনার জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কৃষি খাত থেকে প্রবৃদ্ধি কমে সেবা ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি মানেই হলো আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য বাস্তবায়নে আগামী অর্থবছরে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে। গত ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত আমাদের রাজস্ব আদায়ের গড় প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এ হার ১৭ শতাংশ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আয় করা যাবে ১৯ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের প্রয়োজন হবে ৪০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। কর আদায়ে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম ছাড়াও করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। সংস্কারের মাধ্যমে আয় হবে ১১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। রাজস্ব বিষয়ক বিভিন্ন মামলা নিষ্পতির মাধ্যমে ২৬ হাজার কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্য রয়েছে। সিগারেট থেকে রাজস্ব আদায় হবে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। মোবাইলে কথা বলার মাধ্যমে আয় হবে এক হাজার কোটি টাকা, গার্মেন্টস শিল্পে উৎসে কর থেকে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং সেবা খাতে থেকে ৪০০ কোটি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বর্ষাকালে রাস্তা বা নদী শাসনের মতো কাজের কারণে এডিপির অর্থ অপচয় হয়। এছাড়াও নানাভাবে প্রকল্প পরিচালদের কারণে সরকারী অর্থের অপচয় হচ্ছে। সরকারের সাফল্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টার্গেট পূরণে আমেরিকা পৌঁছানোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হলেও লন্ডন পৌঁছানো গেছে। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্যবস্থাপনার কারণে অপচয় হচ্ছে। এটা ঐতিহাসিকভাবে চাপিয়ে দেয়া। নতুন বিভাগ, অফিস এবং আমলাতন্ত্রের কারণেও অপচয় বাড়ছে। এর থেকে বের হওয়ার শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর নেই। শেষ দিকে এডিপি বাস্তবায়নের প্রবণতা বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বছরের শেষ দিকে এসে মূল বরাদ্দ ব্যয় করা হচ্ছে। মূলত বর্ষাকালে কাজের প্রতিবন্ধকতা, মাঠে যাওয়ার আগে কাগজ তৈরির কারণে অর্থবছরের প্রথম দিকে বাজেট বাস্তবায়ন করা যায় না। এছাড়া আমাদের এ অঞ্চলের নিয়মই হয়ে গেছে ধীরেসুস্থে যাওয়া। প্রকল্প পরিচালক কিছু কাজ বাকি রেখে দেয় আবার অনেক প্রকল্প পরিচালক চার থেকে পাঁচটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ কারণে বাস্তবায়ন কাজ গতি পায় না। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। আর অর্থবছরের শেষ দুই মাসে ব্যয় হচ্ছে বরাদ্দের ৪০ শতাংশ। এ দুই মাসে তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থ অপচয় হচ্ছে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দুই মাসে ৪০ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটি হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ সময় গুণগতমান বজায় রাখা সম্ভব নয়। বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে উৎসে কর আগে যেটা ছিল সেটাই যেন রাখা হয়। এমনিতেই পোশাক শিল্পে নানা খাতে কর দিতে হয়। দশমিক ৩ ভাগ থেকে ১ ভাগ উৎসে কর বাড়ানো আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। পোশাক শিল্প কারোর একার সম্পদ নয়, এটা দেশের জনগণের সম্পদ। সেই হিসাবে কেন যে পোশাক খাতে বাজেটে কর বাড়ল তা আমাদের বোধগম্য নয়। ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম বলনে, সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলেও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের বেতন না বাড়ানোর ফলে বৈষম্য বাড়বে।
×