ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইস্কাটনে জোড়া খুনের আসামি এমপির ছেলে রনি জেলে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৪ জুন ২০১৫

ইস্কাটনে জোড়া খুনের আসামি এমপির ছেলে রনি জেলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত ১৩ এপ্রিল মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় যানজটে বিরক্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠের পরিবহন পুলের এক সিএনজিচালক ও এক রিক্সাচালকের মৃত্যুর ঘটনায় রিমান্ড শেষে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। শনিবার বিকেলে চারদিনের রিমান্ড শেষে রনিকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশের তরফ থেকে নতুন করে কোন রিমান্ডের আবেদন করা হয়নি। রনির পক্ষে তার আইনজীবী শওকত ওসমান জামিনের আবেদন করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর আগামী ১৬ জুন রনির জামিনের আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ঘটনার সময় রনির সঙ্গে থাকা তিন বন্ধুকে শনাক্ত করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের আটক বা গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে। তাদের এ মামলায় গ্রেফতার অথবা আটক অথবা রাজসাক্ষী করা হতে পারে। এছাড়াও ওই তিন বন্ধুর বিরুদ্ধে গুলি চালানোর জন্য রনিকে প্ররোচিত করার অভিযোগও আনা হতে পারে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে। ওইদিন রাত দু’টায় রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন নিউ ইস্কাটনের দিলু রোড মোড়ে ঘটনাটি ঘটে। ঘটনার সময় দৈনিক জনকণ্ঠের পরিবহন পুলের সিএনজিচালক ইয়াকুব আলী (৪৫) দাফতরিক কাজে দিলু রোডে যাচ্ছিলেন। দিলু রোডের মোড়ে যানজটে একটি প্রাডো গাড়ি থেকে আচমকা এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। গুলিতে ইয়াকুব আলী ও রিক্সাচালক হাকিমসহ (৩০) তিনজন আহত হন। আহতদের মধ্যে ইয়াকুব ও হাকিমকে রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত অপর রিক্সাচালক ফার্মেসি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে যান। গত ১৫ এপ্রিল গুলিবিদ্ধ রিক্সাচালক হাকিমের মৃত্যু হয়। তার পিতার নাম দুদু মিয়া। বাড়ি জয়পুরহাট জেলার কালাই থানাধীন দেওগ্রামে। হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম (৫০) জানান, তার দুই ছেলে এক মেয়ে। হাকিম সবার বড় ছিল। তারা মগবাজারের মধুবাগ বস্তিতে বসবাস করেন। আর গত ২৩ এপ্রিল সিএনজিচালক ইয়াকুবের মৃত্যু হয়। তার পিতার নাম আরব আলী শেখ। বাড়ি বাগেরহাট সদর জেলার কাঁটাবনিয়া গ্রামে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ইয়াকুব সবার বড় ছিলেন। ইয়াকুব আলীর স্ত্রী সালমা বেগম ও দুই ছেলে জামাল (১৫) আর বাবুকে (১৩) নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন নন্দীপাড়ার বটতলার মোয়াজ্জেম কলোনির ক্যাম্প গলির জব্বারের বাড়িতে মাসিক ১৮শ’ টাকায় একটি কক্ষে ভাড়ায় বসবাস করছেন। এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা বাদী হয়ে রমনা মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ মে দুপুরে মামলা তদন্তের ধারাবাহিকতায় রাজধানীর ধানম-ি থেকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয় বখতিয়ার আলম রনির (৪২) গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে। ইমরান ফকির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই গুলিবর্ষণকারী রনির নাম প্রকাশ করেন। ইমরানের তথ্যমতে সেদিন রাতেই ধানম-ি ৪ নম্বর সড়কের আরবান গ্রেসের ২৫ নম্বর বহুতল বাড়ির ৩/সি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করা হয় রনিকে। এ ফ্ল্যাটটিতে রনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বসবাস করত। রনিকে গ্রেফতারের সময় তার তুরস্কের তৈরি (সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ) বৈধ পিস্তলটি ২১ রাউন্ড গুলি ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬২৩৯ নম্বর কালো প্রাডো গাড়িটি জব্দ করা হয়। পরদিন ১ জুন গ্রেফতারকৃতদের ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়। সোপর্দ করে রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ড শেষে আদালতে রনির গাড়িচালক ইমরান ফকির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে তিনি জানান, সিএনজি আর রিক্সায় রাস্তায় যানজট লেগে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে মাতাল অবস্থায় রনি নিজের বৈধ পিস্তল থেকে গুলি চালান তিনি। এদিকে রিমান্ডে আনার পর পরই রনি অসুস্থ হয়ে পড়ার ভান করেন। দ্রুত তাকে প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা রনির অসুস্থতার কোন কারণ নেই বলে নিশ্চিত হয়। এরপর রনিকে উন্নত চিকিৎসার শেরেবাংলানগর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে রনির কোন রোগ নেই বলে মতামত দেন চিকিৎসকরা। এরপর সেখান থেকে রনিকে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তার কোন রোগ নেই বলে চিকিৎসকরা মত দেন। শেষ পর্যন্ত গত ৯ জুন রনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারদিনের হেফাজতে নেয় ডিবি পুলিশ। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, রিমান্ডে থাকাকালীন রনি গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ওইদিন মাতাল অবস্থায় তিনি যানজটে বিরক্ত হয়ে গুলি চালিয়েছেন। তবে গুলিতে কেউ মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন কিনা সেটি তার অজানা ছিল। ডিবির ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ওইদিন রাতে রনি প্রাডো গাড়িটি নিয়ে বের হয়। চালক ছিল ইমরান ফকির। তারা প্রথমে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় আসে। সেখান থেকে তার বন্ধু টাইগার কামালকে সঙ্গে নিয়ে বাংলামোটর শ্যালে রেস্তরাঁয় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিয়ার আর মদ পান করে। প্রচ- মাতাল হয়ে পড়ে তারা। সেখানে বসেই রনির কথা হয় জাহাঙ্গীর নামে একজনের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর সোনারগাঁও হোটেলের একটি ডিজে পার্টিতে ছিল। সেখান থেকে রনিকে সোনারগাঁও হোটেলে যেতে বলে। রনি ও টাইগার কামাল চালককে সঙ্গে নিয়ে গাড়িসহ সোনারগাঁও হোটেলে যায়। সেখানে ডিজে পার্টিতে অংশ নেয়। সেখানেও পর্যাপ্ত মদ ও বিয়ার পান করে। নানা ধরনের মদ বিয়ার পান করায় মারাত্মক বেসামাল হয়ে পড়ে তারা। এরপর সোনারগাঁও হোটেল থেকে রনি, টাইগার কামাল, জাহাঙ্গীর ও জাহাঙ্গীরের এক বন্ধু গাড়িতে ওঠে। রনি চালকের বাম পাশের সিটে ছিল। অন্য তিনজন গাড়ির পেছনের সিটে। গাড়িটি সোনারগাঁও হোটেল থেকে বেরিয়ে বাংলামোটর হয়ে সোজা মগবাজারে যায়। সেখানে একজনকে নামিয়ে দেয়। এরপর গাড়িটি সোজা বাংলামোটর সড়ক ধরে ধানম-ির দিকে যেতে থাকে। দক্ষিণ দিকের রাস্তায় খানাখন্দ ও চাপা থাকায় গাড়িটি উল্টো দিক দিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার একপাশে ব্রিজের বড় বড় ভারি বোল্ডার ফেলে রাখায় ওই সময় দিলু রোডের মোড়ের কাছে সিএনজি আর রিক্সায় যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটে বিরক্ত হয়ে রনি পিস্তল থেকে গুলি চালায়। গুলি চালানোর সময় রনি চালকের বাঁ পাশের সিটে বসা ছিল। ডিবি সূত্রে আরও জানা গেছে, নিহত রিক্সাচালক হাকিম ও সিএনজি চালক ইয়াকুবের দেহ থেকে উদ্ধারকৃত বুলেটের খোসা জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত বুলেটের খোসা ও রনির কাছ থেকে জব্দকৃত পিস্তল এবং পিস্তলের বুলেটের ব্যালিস্টিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। রনির পিস্তলের বুলেট ও নিহতদের দেহ থেকে জব্দকৃত বুলেটের খোসা একই। পয়েন্ট থ্রি টু বোরের বুলেটের খোসা। রনির পিতা শামছুল আলম (মৃত)। তিনি অগ্রণী ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। রনি ২০০৩ সালে বিয়ে করেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে তার প্রথম সন্তানের মৃত্যু হয়। মেজো মেয়ে জীবিত। সর্বশেষ ৪০ দিন বয়সী ছোট মেয়েটি ঘটনার একদিন পর ১৫ জুন এ্যাপোলা হাসপাতালে মারা যায়। ব্যক্তি জীবনে অস্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত রনি। তারা দুই ভাই। রনি বড়। ছোট ছেলে রন্টিকে নিয়ে সংসদ সদস্য পিনু খান রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের ১৮/ডি নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক দীপক কুমার দাশ জনকণ্ঠকে জানান, ওইদিন গাড়িতে থাকা অপরদের সন্ধান চলছে। যানজটে বিরক্ত হয়ে রনি তার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলি চালায়। রনির পিস্তলের লাইসেন্স সঠিক কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ব্যালিস্টিক পরীক্ষায় রনির পিস্তলের গুলিতে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটার বিষয়টি নিশ্চিত হলে, রনির আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হবে। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, শনিবার দুপুরের পর রনিকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়। রনির পক্ষে তার আইনজীবী শওকত ওসমান জামিনের আবেদন করেন। আদালত আগামী ১৬ জুন শুনানির দিন ধার্য করে রনিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
×