ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাল চন্দ্র মিত্র

লড়াইটা আদর্শের, তাই...

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৪ জুন ২০১৫

লড়াইটা আদর্শের, তাই...

“United we stand, divided we fall”, অর্থাৎ ঐক্যে স্থিতি, বিভেদে বিনাশ কথাটি খুবই ঠিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ আজ দুই মেরুতে বিভক্ত। একদিকে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তাবাদ থেকে জন্ম নেয়া ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। অন্যদিকে দ্বিজাতি-তত্ত্বভিত্তিক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ফসল মৌলবাদী পাকি বাংলাদেশ। এক পক্ষে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ডান-বাম নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধারা। অন্য পক্ষে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাক হানাদারদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার-আলবদর পক্ষ শক্তির নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দেশের চলমান সঙ্কট সংঘর্ষের মূল কারণ কিন্তু এখানেই নিহিত। এটিকে শুধুই দুই দল বা দুই নেত্রীর ঝগড়া বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলে চিত্রিত করা ঠিক হবে না। এ দ্বন্দ্ব দুটি আদর্শের মধ্যে। দুটি মনস্তত্বের মধ্যে। এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা রয়েছে। সেটি হলো সত্তরের নির্বাচনে দেশের প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ ছয় দফার পক্ষে এবং প্রায় ত্রিশ শতাংশ মানুষ বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। জাতির বিভাজনের সূচনা সেখান থেকেই। নির্বাচনে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে পাক সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর গণহত্যা শুরু করে। ফলে বাঙালীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হন। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধে ছয় দফার বিরুদ্ধে ভোট দেয়া জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল (মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি) ও তাদের নেতারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে জিগির তুলে হানাদার পাক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় এবং বাঙালী নিধনে লিপ্ত হয়। নয় মাস যুদ্ধের পর পাক বাহিনী পরাজিত ও আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদররা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আত্মগোপনে চলে যায় এবং গোপনে সংগঠিত হওয়াসহ সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সে সুযোগের সৃষ্টি হয়। তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতা, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে মুক্তি ও স্বাধীনতা বিরোধীরা পুনর্বাসিত ও সংগঠিত হয়। বিদেশে পলাতক ঘাতক নেতারা (গোলাম আজম গং) দেশে ফিরে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের প্রকল্প বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেন। জনগণের ভোটদানে ঐতিহাসিক ভুলের কারণে ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার সুযোগ পায়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার দল বিএনপি এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। সর্বশেষে ২০১৩-২০১৫ তে এসে বিএনপি নামক দলটি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের আগ্রাসন এবং নিয়ন্ত্রণে এসে পড়ে। সত্তরের ছয় দফা বিরোধী ভোটার সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে পঞ্চান্ন শতাংশের কাছাকাছি বা তার কিছু বেশিও হতে পারে। মুনতাসীর মামুন কথিত হেজাবি এবং কতিপয় সুশীল বুদ্ধিবাজের প্ররোচনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নতুন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে পাকিস্তানী মনস্তত্বের ক্রমশ প্রসার ঘটে। এ রকম একটি সময়ে বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি একটি অঘোষিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছে। এ যুদ্ধের কোন সহজ সমাধান নেই। সংলাপে এ সঙ্কটের মীমাংসা হবে বলে মনে হয় না। কোন এক পক্ষের পরাজয় ও নিষ্ক্রিয়করণ অবধারিত। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে এর পক্ষ শক্তির বিজয় এবং বিরুদ্ধাবাদীদের পরাজয়ের কোন বিকল্প নেই। স্বাধীনতা বিরোধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের পরাজয় ও নির্মূলকরণ নিশ্চিত করতে আমজনতার সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। বুলেট, ককটেল, পেট্রোলবোমা নয়, ব্যালটের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নিশ্চিত করতে হবে। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে যেভাবে নির্মূল করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে আগামী নির্বাচনে গণভোটের আদলে ব্যালটের অস্ত্রে বিএনপি-জামায়াত চক্রকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে পরাজিত ও নির্মূল করতে হবে। অন্য কোন পথ খোলা নেই। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, পটুয়াখালী
×