ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইফতেখার আহমেদ খান

উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৪ জুন ২০১৫

উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ

সাধারণ অর্থে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনীতির প্রতি জনগণের মনোভাব। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং গতিধারার প্রতি সাধারণ মানুষ কি রূপ মনোভাব পোষণ করে, তা-ই হলো কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রবার্ট ঢাল (জড়নবৎঃ উযধষ) তার আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ (গড়ফবৎহ চড়ষরঃরপধষ ধহধষুংরং) শীর্ষক গ্রন্থে মানুষের রাজনৈতিক মনোভাবের চারটি প্রকরণ আবিষ্কার করেছেন। এগুলো হলো- অরাজনৈতিক (অঢ়ড়ষরঃরপধষ), রাজনৈতিক (চড়ষরঃরপধষ) ক্ষমতা অন্বেষণকারী (চড়বিৎ ংববশবৎ), ক্ষমতাধারী (চড়বিৎভঁষ). মানুষের রাজনৈতিক মনোভাবের এই মনোজ্ঞ দৃশ্যায়ন নির্মাণ করে রবার্ট ঢাল স্মরণীয় হয়ে আছেন। উল্লিখিত চার ধরনের প্রেক্ষিতের ব্যাখ্যায় তিনি দেখিয়েছেন, কি কারণে ভিন্ন মানুষ রাজনীতির প্রতি ভিন্ন আচরণ করে। অরাজনৈতিক পর্বের অন্তর্ভুক্তগণ রাজনীতির প্রতি উদাসীন, রাজনৈতিক পর্বের অন্তর্ভুক্তরা রাজনীতির প্রতি সচেতন, ক্ষমতা অন্বেষণকারীরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে ক্ষমতা পেতে চান এবং ক্ষতাধারীরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত থেকে ক্ষমতার অধিকারী হন। ‘ঢাল’ তার বিশ্লেষণে শতকরা নব্বইভাগ মানুষকে অরাজনৈতিক পর্বে ফেলেছেন। এজন্য তিনি বেছে নিয়েছেন মানুষের রাজনৈতিক মনোজগত। এর ভিত্তিতেই মূলত তিনি তার এ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। আমরা যদি এই সূত্র দিয়ে ইংল্যান্ডে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চরিত্রের তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে উভয় দেশের বেশিরভাগ মানুষই অরাজনৈতিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ উভয় দেশের বেশিরভাগ মানুষ রাজনীতির প্রতি উদাসীন। তথাপি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলাদেশ থেকে বহুগুণে উন্নততর। প্রশ্ন হলো, এর কারণ কি? এই কারণ বিশ্লেষণে বহু বক্তব্য আলোচনায় চলে আসবে। যে কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটাই সেই দেশের রাজনৈতিক ক্রমবিবর্তন এবং ইতিহাসের উত্তরাধিকার। একজন ব্যক্তি কোন না কোন ভাবে তার নিজের চিন্তা ও চেতনায় উত্তরাধিকার বহন করে সচেতনে বা অসচেতনভাবে। এখানে যদি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির প্রসঙ্গ নিয়ে আসি, তবে দেখতে পাব দেশটির মানুষের রাজনৈতিক মনোজগত কোনকালেই উদারনৈতিক, নিরপেক্ষ কিংবা বলা যেতে পারে আধুনিক রাজনৈতিক শর্তের উপাদান কিংবা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ইত্যাদি দ্বারা বিকশিত হয়নি। বর্তমানকালে আধুনিক ধারার নিয়ম পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রের সরকার গঠিত হলেও, যেমন আইন বিভাগ বিচার শাসন বিভাগ ইত্যাদি আধুনিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বৈশিষ্ট্য বলবত থাকলেও জনগণের মনোঅভিসন্দর্ভে উদারনৈতিক রাজনৈতিক চিন্তা প্রতিষ্ঠা পায়নি। যখন থেকে আধুনিক রাজনৈতিক চর্চা বিশ্ব পরিক্রমায় অনুশীলন হতে লাগল, তখন থেকে এবং তারও বহু আগে থেকে সেখানকার অধিবাসীরা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী শর্ত মোতাবেক উদারনৈতিক শাসন পদ্ধতির আওতায় আসেনি। এই কারণেই চিন্তা ও কর্মে তাদের সেই পূর্বতন ধর্মভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক, একইভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তরাধিকার মনোজগতে বিরাজমান থাকায় উপনিবেশ পরবর্তী আধুনিক শাসনের উপাদানের উপস্থিতিতেও সেখানকার মানুষের চেতনায় উদারনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। সুতরাং দেখা যায়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি তা যে ধারারই হোক তা নির্ভর করে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের জনমানসের রাজনৈতিক চর্চা এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সংস্কৃতির ব্যাখ্যার আগে ইংল্যান্ডের সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং এর ওপর উত্তরাধিকারের প্রভাব সামান্য পরিসরে দেখা যেতে পারে। ইংল্যান্ড এবং বাংলাদেশ উভয় অংশের মানুষ রবার্ট ঢালের অরাজনৈতিক পর্বের অন্তর্ভুক্ত হলেও ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি উন্নত এবং তা আধুনিক। আমরা যদি রাজনৈতিক চর্চায় জনঅংশগ্রহণের মাত্রা সংখ্যাগতভাবে পরিমাপ করি, তবে দেখতে পাই ইংল্যান্ড অপেক্ষা বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। তথাপি ইংল্যান্ড উন্নত। তার মৌল কারণ হলো, ইংল্যান্ডের মানুষ উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ইংল্যান্ড রাজা রানী শাসিত দেশ, যা পূর্বতন অনাধুনিক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনের প্রতিনিধিত্ব করে। তথাপি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আধুনিক ও উন্নত। বলা প্রয়োজন, যত আগে থেকে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক চিন্তার ভিত্তি গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর আর কোথাও এরূপ আর দেখা যায় না। ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক কিংবা শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনের কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এক. ১২১৫ সালের মেগনাকার্টা, ১২১৫ সালের ১৫ জুন রুনীমিড নামক স্থানে সমবেত হয়ে জনতা রাজার নিকট তাদের অধিকারের দাবি সম্বলিত মহাসনদ পেশ করে। বস্তুতপক্ষে এটি মৌলিকভাবে জনগণের অধিকারের সনদ ছিল না। ছিল ভূমিপতি ও যাজক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণে প্রদত্ত কিছু অধিকার। তথাপি এটি আধুনিক গণতন্ত্র নির্মাণের একটি ভিত্তিপ্রস্তর। দুই. ১২৬৫ সালে ২ জন নাগরিক প্রতিনিধি সেই সময়ের পার্লামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তিন. ১২৯৫ সালে রাজা প্রথম এডওয়ার্ড (ঊফধিৎফ-১) সর্বশ্রেণীর প্রতিনিধি নিয়ে আদর্শ পার্লামেন্ট (গড়ফবষ চধৎষরধসবহঃ) আহ্বান করেন। চার. ১৬২৮ সালে রাজা প্রথম চার্লস অধিকারের আবেদন (চবঃরঃরড়হ ড়ভ জরমযঃং ) মেনে নিতে বাধ্য হন। পাঁচ. ১৬৮৮ সালে গৌরবময় বিপ্লব (এষড়ৎরড়ঁং জবাড়ষঁঃরড়হ), ছয়. ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল (ইরষষ ড়ভ জরমযঃং), সাত. ১৮৩২ সালের সংস্কার আইন (জবভড়ৎস অপঃ) পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। আট. ১৯০৬ সালে শ্রমিকদের জন্য গঠিত হয় লেবার পার্টি। দেখা যাচ্ছে, এক হাজার বছর আগে সেখানে রাজনৈতিক চিন্তার জন্ম। এত শত বছরব্যাপী প্রতিষ্ঠা পাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজ এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এসবের সাপেক্ষে যদি বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ১২১৫ সালে এখানে রাজনৈতিক চিন্তা গড়ে ওঠার কোন আলামত দেখা যায় না। সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামাজিকভাবে ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদ এবং অযুক্তি ও কুসংস্কার সেই সময়ের প্রধান সামাজিক বৈশিষ্ট্য। আর রাজনৈতিকভাবে রাজার মতের বিরুদ্ধে চোখ তুলে তাকানোর শাস্তি ছিল শিরñেদ। ১৮শ’ পরবর্তী শিল্প বিপ্লব এবং এর ফলে আধুনিকতা ইত্যাদিও জোড় কদমে এ অংশে হেঁটে যেতে পারেনি। ধর্মের ভুল আচরণ আমাদের এই অংশের সমাজজীবনে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। ইউরোপে যখন মধ্যযুগের অযুক্তি কাটিয়ে রেনেসাঁর আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছিল, তখনও এবং ১৮শতকে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপে যখন আধুনিকতার মাধ্যমে যুক্তির কাল ফুলেফেঁপে বিকশিত হয়ে উঠেছিল, তখনও আমাদের দেশে মধ্যযুগের অযুক্তি আর কুসংস্কারের অন্ধকারই ছিল জীবন ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই সেদিন জিন্নাহ নামের এক ভদ্রলোক, যিনি কোন দিন নামাজ পড়েননি, তিনি ধর্ম দিয়ে এক রাষ্ট্র গঠন করে ফেললেন, মুসলিম লীগ বানিয়ে মানুষকে আবারও ‘মধ্যযুগের ভূত’ করে রেখেছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিঃসন্দেহে একটি জ্ঞানভিত্তিক অভিযান এবং যুক্তি প্রতিষ্ঠার চমৎকার এক পরিপ্রেক্ষিত। এই অভিযানের ফল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা একটি বড় আকারের জ্ঞানের অভ্যুদয়। জ্ঞানভিত্তিক মানসের সব শর্ত সহযোগে তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের মৌলিক সংবিধানের গঠনতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদ সবই শাসনের আধুনিক রীতি এবং একইভাবে একেকটি জ্ঞান। এই জ্ঞান উপলব্ধির জন্যও প্রয়োজন, যা সবার থাকে না। এত সুন্দর আর যৌক্তিক সর্বজনীন সংবিধান ধারাবাহিকতা পায়নি। জিয়াউর রহমান নামক এক সেপাহী একে নস্যাত করে আবারও সেই পাকিস্তানী নীতি এবং ফেলে দেয়া পরিত্যক্ত মধ্যযুগের নীতিকে শাসনের মৌল কাঠামো হিসেবে দাঁড় করাল। পাঠক, এই ঘটনা কিংবা বলা যেতে পারে এই জাতীয় ঘটনা ইউরোপে ঘটেছে ১৫ কিংবা ১৬শ’ শতাব্দীতে। অর্থাৎ চার শ’ বছর আগে। ইউরোপে সেই ১২০০ সাল থেকে অন্ধকার দূর করতে করতে আজ এই জায়গায় এসেছে। আর আমাদের দেশে অন্ধকার দূর করার হিসাব করার মতো পদক্ষেপ শুরু হয় এই সেদিন ১৯৪৭ সালের পর। আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তি প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ হতে ১৯৭৫ এই ক’দিন টিকে ছিল প্রতিষ্ঠা পাওয়া যুক্তি। তারপর আবার ঘোর অন্ধকার। এই বিশ্লেষণই বলে দেয় ইংল্যান্ড এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাবার্ট ঢালের সূত্র মতে, অরাজনৈতিক পর্বের অন্তর্ভুক্ত হলেও কেন ইংল্যান্ড বাংলাদেশ অপেক্ষা উন্নত। লেখক : উন্নয়নকর্মী ও গবেষক
×