ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের বাজেট কিছু ভুল সঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৪ জুন ২০১৫

একুশ শতক ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশের বাজেট কিছু ভুল সঙ্কেত

॥ দুই ॥ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাজেটের ইতিবাচক বিষয়গুলো হচ্ছে: ক. সফটওয়্যার ও সেবা খাতের কর অবকাশ ২০২৪ সাল অবধি বাড়ানো। খ. কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্যামেরার শুল্ক ২৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগ করা গ. সিম কর ৩০০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করা। ঘ. অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ ইত্যাদি সফটওয়্যার ব্যতীত অন্য সফটওয়্যারের ওপর শতকরা ৫ ভাগ শুল্ক আরোপ করা। ঙ. হাইটেক পার্কে যারা ব্যবসা করবেন তাদের জন্য বিদ্যুত ও ভ্যাট মওকুফ করা। আমরা বাজেটের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করব। সার্বিক বিবেচনায় শুরুতেই আমি তাই মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে এই বাজেট পেশ করার জন্য অভিনন্দিত করছি। বাজেটের ভাল-মন্দ ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আরও আলোচনা হতেই থাকবে। সংসদে ও সংসদের বাইরের এসব আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসবে বাজেটের ভাল-মন্দ দিকগুলো। দেশের প্রেক্ষিত থেকে বাজেট দেখার চাইতে আমাদের আগ্রহ অনেক বেশি থাকে এর ইনফোকম বিষয়গুলো। এরই মাঝে এফবিসিসিআই বাজেটকে স্বাগত জানিয়েছে। ১৪ দল খুব সঙ্গতকারণেই বাজেটকে অভিনন্দিত করেছে। বিএনপি ও ২০ দল এখনও একে কথামালার বাজেট বললেও সুস্পষ্ট কোন সমালোচনা করেনি। সার্বিকভাবে বাজেট নিয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক সমালোচনার সুযোগ হয়ত নেই। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাজেটের বিষয়গুলো অনেকটাই আশাব্যাঞ্জক। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাজেটের কিছু কর কাঠামো নিয়ে এরই মাঝে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের সেই প্রসঙ্গগুলোই আলোচনায় আনা দরকার। অর্থমন্ত্রী সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাজেটে বলেছেন : ১. কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন ২. বিদ্যুত, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ ৩. কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ ৪. আইসিটি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা সংক্রান্ত সেবা রফতানিতে সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন। ৫. সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগে গতিশীলতা আনয়ন । ৬. রফতানির গতিশীলতা ও একই সঙ্গে পণ্যের বৈচিত্রায়ন। তিনি চলতি বছরে জুলাই থেকে এসব লক্ষ্য পূরণের কাজ চলবে বলে বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ করেন। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এখানে কেবল আইসিটি সেবা রফতানির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই অভিপ্রায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকারের পুরোটা হতে পারে না। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চ্যালেঞ্জ যেমন আমাদের আছে তেমনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জও আছে। তবে এটি বোধহয় বোঝা দরকার যে, আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার কিসে? আমার মনে হয়নি, ডিজিটাল বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় আকাক্সক্ষা হিসেবে অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় রয়েছে। যদি সেই প্রেক্ষিতটি থাকত তাহলে অর্থমন্ত্রী সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রাকে নতুন প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করতেন। অবশ্য কেবল এখানেই নয়, বাজেটের সামগ্রিক উপস্থাপনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ সেই গুরুত্ব বহন করেনি যা এর প্রাপ্য। আমি খুব বিনীতভাবে বলতে পারি যে, একুশ শতকের বাংলাদেশকে একেকবার একেক নামে অভিহিত না করে আমরা কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে যদি অভিহিত করতে পারি তবেই আমাদের লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে পারতাম। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের টাকার শ্রাদ্ধ করে বাংলাদেশের ব্রান্ডিং করার জন্য যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে সেখানেও ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিধাটিই প্রধান উপজীব্য হতে পারে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় আছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ যে বঙ্গবন্ধুর একুশ শতকের সোনার বাংলা তার প্রতিফলন নেই। আমি লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ নামক অসাধারণ জনপ্রিয় ও সর্বস্তরে গৃহীত একটি ধারণাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে বজায় রাখতে পারছে না। সরকারের সকল কর্মকা-ে ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগানটির উচ্চ মর্যাদা থাকে না। আইসিটি ডিভিশন এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ও বেসিসের মেলার সেøাগানগুলোতে এখন একটি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করে চলেছি যে পারতপক্ষে ডিজিটাল বাংলাদেশ যেন না বলা হয়। বেসিস ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর থেকেই এর বিপরীতে অন্য সেøাগান দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। তাদের পাল্টা সেøøাগান ছিল বাংলাদেশ নেক্সট। এটি দিয়ে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর, সমৃদ্ধি বা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার কি অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয় সেটি আমি বুঝি না। এটি বাংলাদেশের আইসিটি খাতের সেবা রফতানির একটি সেøাগান হতে পারে। কিন্তু সেটি কি ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøাগানের বিকল্প হতে পারে? সরকারের আইসিটি ডিভিশনের সঙ্গে তারা যখন মেলার আয়োজন করে তখন বাংলাদেশ নেক্সট, মিট নিউ বাংলাদেশ এসব সেøাগান দেয়। এবার জোর করে বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোর প্রস্তাবিত মিট নিউ বাংলাদেশ সেøাগানকে মিট ডিজিটাল বাংলাদেশ সেøøাগান প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি জানি না শেষ অবধি সেটি থাকবে কিনা। ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এর সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট করেই একটি কথা বলার চেষ্টা করেছি যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বস্তুত একুশ শতকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। আমি বহুবার বলেছি, “ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ যা সকল প্রকারের বৈষম্যহীন, প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি বাঙালীর উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। এটি বাংলাদেশের সকল মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপকল্প। এটি বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ, উন্নত ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার। এটি বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সোপান। এটি বঙ্গবন্ধুর একুশ শতকের সোনার বাংলা।” অর্থমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নটিকেই কখনও সম্ভাবনার বাংলাদেশ বা কখনও মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা কখনও সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ বলে অভিহিত করছেন। এই সঙ্কটটি সরকারের সারা অঙ্গেই আছে। বস্তুত ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে আত্মস্থ করার অবস্থাটি সরকারে নেই। সরকারী দল আওয়ামী লীগেও নেই। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সরকারের সকল অঙ্গ ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আইসিটি ডিভিশন বা তথ্যপ্রযুক্তিকেই বোঝে। ফলে কখনও ডিজিটাল বাংলাদেশ উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হয়, কখনও ডিজিটাল বাংলাদেশ তার পথ হারিয়ে ফেলে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন যে, এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বহমান উদ্যোগসমূহ রয়েছে। আমি নিজে মনে করি অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য যথাযথ। এ বছরের বাজেটে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আরও অনেক উদ্যোগের কথা বলেছেন। এসব বিষয়ে মোটা দাগে আমার বলার কিছু নেই। তবে প্রকল্পসমূহ যথাযথভাবে প্রয়োজন অনুসারে বাস্তবায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার বক্তব্যে আগেই বলেছি যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে বিবেচনা না করার ফলে বাজেটের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্থাপন করা হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি হয়েই আছে। আমি এখনও আশা করব কোন না কোনভাবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশকেই আমাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থাপন করা হবে। যাহোক, বাজেটটি ডিজিটাল বাংলাদেশের না হলেও আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারের আন্তরিকতা ও উৎসাহকে আমি অভিনন্দিত করছি। একই সঙ্গে সরকার এই বাজেটে যেসব ক্ষেত্রে কর ও মূসক প্রয়োগ করেছে সেগুলো নিয়ে একটু কথা বলা দরকার। আমরা লক্ষ্য করেছি, অনলাইন কেনাকাটায় শতকরা ৪ ভাগ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মোবাইল সেবার ওপর শতকরা ৫ ভাগ সম্পূরক কর আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত একটি ভাল কাজের সংশোধনীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকার কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্যামেরার ওপর কর হার ২৫ ভাগ থেকে শতকরা ১০ ভাগ করেছে। ধন্যবাদ অর্থমন্ত্রীকে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ওয়েব ক্যাম বা সিসি ক্যাম-এর দাম কমবে। কিন্তু ডিজিটাল ক্যামেরার দাম কমবে না। এর মানে দাঁড়াবে যে, সাধারণভাবে ব্যবহৃত ডিজিটাল ক্যামেরার চোরাচালান অব্যাহতই থেকে যাবে। আমি অনুরোধ করব সরকার যেন ডিজিটাল ক্যামেরাকেও এই কর হ্রাসের আওতায় নিয়ে আসে। অন্যদিকে ই-কমার্সের ওপর ভ্যাট আরোপ, ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার না করা ও মোবাইল সেবার ওপর শতকরা ৫ ভাগ সম্পূরক কর আরোপ সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে একটি ভুল সঙ্কেত প্রদান করছে। সাধারণ মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখছে তার মাঝে একটি বড় বিষয় হলো ইন্টারনেটের প্রসার। একইভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের একটি বড় প্রত্যাশা। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে ই-কমার্স খাতে ট্রেড লাইসেন্স করার মতো অবস্থা তৈরি না করেই এর ওপর ব্যাট আরোপ করা হয়েছে। এটি আঁতুড় ঘরেই শিশু মেরে ফেলার মতো একটি কাজ। অর্থমন্ত্রী নিজেই জানেন যে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রসার জিডিপির প্রবৃদ্ধি আনে। আমরা ২০০৯ সাল থেকেই ইন্টারনেটের ভ্যাট প্রত্যাহার করার কথা বলে আসছি। সরকার সেটি না করে নতুন করে সম্পূরক কর আরোপ করায় পুরো বিষয়টিকেই দুঃখজনক বলে মনে করতে হবে। আমি পুরো বিষয়গুলো সরকারকে সুবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করার অনুরোধ করব। ঢাকা, ১২ জুন, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×