ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষাকালে নিত্য সহায়, এমন বন্ধু আর কে আছে...

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৩ জুন ২০১৫

বর্ষাকালে নিত্য সহায়, এমন বন্ধু আর কে আছে...

সমুদ্র হক বছরের অনেকটা সময় ঘরের কোনেই থাকে। হয়ত কোথাও ঝুলিয়ে। ধুলোও জমেছে। সামান্য টোকা দিলেই ধুলা উড়িয়ে সোজা নাসিকায়। শুরু হয় হাঁচির উৎপাত। যাদের ধূলি-এ্যালার্জি তাদের ননস্টপ। এ আরেক যন্ত্রনা। তবু ওই ধূলির পরতে ভরা কালো কাপড়ের বস্তুটি শুধু হাতে না নিলেই নয়, বাইরে গিয়ে হাঁচিকে মাথা মারি গালি দিয়ে মেলেও ধরতে হবে। কারণ বাইরে অঝর ধারায় বৃষ্টি। বারিধারার দিন এসেই গিয়েছে। নীপবনে কৃষ্ণের বাঁশির ব্যঞ্জনাময় তান উঠেছে। মৃদু লয়ে নূপুরের রুমঝুম মধুছন্দে ধ্রুপদীর কোন তালে রাধাও উঠেছে নেচে। আকাশে সুরও ভেসে আসছে ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে এসো কর ¯œান নবধারা জলে...’। এর মধ্যেই গ্রামের মেঠো পথে সুরে সুরে হাঁক দেয় কোন টাইকর, আ——ছে ছেঁড়া— ফাটা কলপি বাঁকা— স্প্রিং নষ্ট লাঠি—- ভাঙ্গা ছা—-তা—-। টনক নড়ে গৃহস্থ কিষান চাষী মজুরদের। কখন বৃষ্টি নামবে কেউ জানে না। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই বলাবলি হয় এই নামলো বলে। এই সময়ে ছাতা ঠিক না থাকেল কি চলে। দুরন্তপনার শিশু-কিশোর ছাড়া কে চায় ভিজতে! শহরে সামান্য বৃষ্টিতেই রিকশাচালকরা চড়া ভাড়া দাবি করে। তখন মনে হয় বড় জলজটের বৃষ্টির মধ্যে ডুবসাঁতার দিয়েই বাড়ি পৌঁছা ভাল। এই অবস্থায় একমাত্র সাহায্যকারী বস্তুটির নাম ছাতা। এই ছাতা শীতে তো নয়ই ফাগুনের বসন্ত বেলাতেও নয়, গ্রীষ্মেরও অনেকটা সময় ঘরে বন্দী থাকে। ধুলো মুছে যতœআত্তি তো দূরে থাক খোঁজও কেউ নেয় না। ছাতাটা অসুস্থ হলো না মরল (অর্থাৎ কোথাও নষ্ট হলো না ইঁদুর কাটল) কে রাখে খোঁজ। বাইরে তখন ফুরফুরে আবহাওয়া। কিছুদিনের জন্য ছাতার কদর প্রায় ফুরিয়েই যায়। প্রকৃতিতে যেই বৃষ্টি ঝরার পালা শুরু অমনি খোঁজখবর কোথায় আছে বৃষ্টির বন্ধু ছাতা। বর্ষাকালের রোমান্টিকতার মূল আকর্ষণই বৃষ্টি। আমাদের কাব্যে সঙ্গীতে গল্পে উপন্যাসে সর্বোপরি মানব জীবনের চিরকালীন সত্তার রোমান্টিকতার অন্যতম উপাদান বৃষ্টি। আর বৃষ্টির সঙ্গে ছাতাকে উপমা দেয়া যায় গানের সুরে ‘দুই ভূবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল রেললাইন বহে সমান্তরাল.....।’ বৃষ্টি ও ছাতা প্রকৃতি ও বস্তুর দুই বাসিন্দা। এদের বয়ে যাওয়া সমান্তরাল। একটা সময় গল্পে উপন্যাসে চলচ্চিত্রে গ্রামের মানুষের চরিত্র চিত্রনে ছাতাকে টেনে আনা হতো। চামচারা ছাতা মেলে ধরত প্রভাবশালীর মাথার ওপরে, গ্রীষ্মে ছায়া দিতে ও বর্ষায় বৃষ্টি না পড়তে। গৃহস্থ ও কিষানরা গ্রীষ্ম বর্ষায় ছাতা ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না। অনেক সময় ছাতা মর্যাদার প্রতীক। গ্রামের পাঠশালা ও স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের হাতে অথবা বগলের নিচে ছাতা রেখে পথ চলা প্রতীকী পরিচয়ের। এই প্রতীকী পথচলার সঙ্গে মাটির স্পর্শের মাটির গন্ধে প্রাণের আকুলতায় বেড়ে ওঠা মানুষের পরিচয় বহন করে। রোদেলা তাপ বৃষ্টির ধারা থেকে মুক্তির ছোট্ট একটি বস্তুর প্রয়োজনটা যে কত তা মৌসুমই বলে দেয়। বর্তমানে কত রকমের যে ছাতা এসেছে...। ছাতার হাতলের সঙ্গে সুইচ টিপলেই মেলে ওঠে। ছাতা যত বড়ই হোক বহনের কত সুবিধা এখন। স্প্রিং ও স্টিল কর্ডে ছাতার টানির প্লাস্টিকের অংশকে নানা কায়দায় ছোট করে ছেলেরা প্যান্টের লুপের সঙ্গে এঁটে মেয়েরা ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বহন করতে পারে। ছাতার হাতলেও এসেছে কত পরিবর্তন। একটা সময় ছাতার হাতল বাংলা ট বর্ণের মতো বাঁকানো থাকত। বর্তমানে এই বাঁকানোকে কতই না দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়েছে। ছাতার কাপড়েও এসেছে পরিবর্তন। এখন কালো কাপড়ের ছাতার সঙ্গে নানা বর্ণের কাপড় ব্যবহার হয়। কোন কাপড়ে আবার নকশি করে বিক্রি হয়। ছাতা যত দৃষ্টিনন্দনই হোক মেলতে না চাইলে কখনও উল্টোমুখী হলে কখনও ভিতরের কোন পার্টসের জন্য বা সেলাই খুলে গেলে মেলতে অসুবিধা হলে টাইকর ছাড়া গতি নেই। ছাতা মেরামতের এসব কারিগরের নাম একেক অঞ্চলে ভিন্নতা আছে। নামে যাই থাক তাদের ব্যাগে ছাতা মেরামতের যন্ত্র একই। সুই সুতো ছোট্ট হাতুড়ি সাঁড়শির সঙ্গে টুকরো কাপড়, ছাতার ভিতরের রিং স্পোক কাঁটা গুনাসহ কত জিনিসই থাকে। একজন টাইকর বললেন, ছাতা মেরামত করার সময় কোন জিনিস ফেলে দেয়া হয় না। নতুন করে পাল্টে নেয়ার পর ওই ভাঙ্গা টুকরো রেখে দেয়া হয়। যাদের ছাতায় সামান্য খুঁত আছে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়। এই টাইকররা এতটাই এক্সপার্ট যে ছাতার যে কোন জায়গায় দ্রুত মেরামত করে দিতে পারে। গ্রামের পথে পথে (এমনকি শহরেও) এই সময়টায় টাইকরদের কদর বেড়েছে। বর্ষায় ছাতা ঠিক না থাকলে পথ চলাই দায়। একটা সময় গ্রীষ্ম বর্ষায় ছাতা ছিল পার্ট অব ইউনিফর্ম। আজও আছে। তবে বাধ্যতামূলক নয়। মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ ছাতা হাতেই ঘর থেকে বের হয়। যাদের গাড়ি আছে ছাতা ব্যবহার না করলেও চলে। মোটরসাইকেল চালকদের রেইন কোট দরকার। অনেকেই রেইনকোট নিয়ে পথ চলেন। বর্তমানে রেইনকোটের চলও বেড়েছে। যতই বাড়ুক ছাতার কদরই আলাদা। আবার এই ছাতা হারায়ও বেশি। বৃষ্টির সময় ছাতা হাতে বের হওয়ার পর রোদ উঠলে ছাতা নেয়ার কথা মনে থাকে না। ছাতা হারিয়ে যাক আর নাই যাক বৃষ্টিতে ছাতার আকর্ষণ মানব জীবনের রোমন্টিকতার চাইতে কম নয়। ভাঙ্গা রোমান্স জোড়া দেয়ার কারিগর হয়ত নেই, ভাঙ্গা ছাতা জোড়া দিয়ে সারিয়ে তোলার কারিগর টাইকররা আছে। ওরা বৃষ্টিতে ভিজলেও মানুষকে ভিজতে দেয় না।
×