ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিবাহ রোধে প্রয়োজন বাধ্যতামূলক জন্ম সনদ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ জুন ২০১৫

বাল্যবিবাহ রোধে প্রয়োজন  বাধ্যতামূলক জন্ম সনদ

মমতা ক্লাস নাইনে পড়ে। বয়স ১৫। লেখাপড়ায় ভাল বলে সংসারে নানা অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও বাবা রমিজউদ্দীন তার পড়াশোনা বন্ধ করেননি। সংসারে স্ত্রী আর ছেলেসহ তিন মেয়ে। দিনমজুর পিতার পক্ষে সবার ভরণপোষণ দেয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। ওদের বাড়ি থেকে দু’তিন গ্রাম পরেই থাকে মমতার খালা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মমতা দেখে খালা এসেছে, মায়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন আলাপ করছে। ওকে দেখেই বলে ওঠে, তোমার মেয়ের জন্য এমন পাত্র হাতছাড়া করবে না। কিছুদিন পরেই বাড়িতে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। কম বয়সী মেয়ের বিয়েতে মমতার বাবার প্রথমে আপত্তি ছিল, কিন্তু মা আর খালার ইচ্ছেতেই শেষ পর্যন্ত মত দেয়। বিয়েতে মমতার মতামতেরও কোন মূল্য দেয়া হয়নি। যথারীতি বিয়ের দিন পাত্রপক্ষ এসে হাজির। কাজী আসার পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবেÑ এমন সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়ে হাজির, সঙ্গে পুলিশও। চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়। কাজী এবং পাত্রপক্ষের লোকজনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। মমতার মা-বাবাও রেহাই পায়নি। এলাকাবাসীতো অবাক, এর আগে গ্রামে অনেক বিয়েশাদি হয়েছে কিন্তু এভাবে কাউকে নাজেহাল হতে হয়নি। সবাই মিলে চেয়ারম্যান সাহেবকে জিজ্ঞেস করল কী অপরাধে এ বিয়ে ভাঙতে হলো। চেয়ারম্যান সাহেব জানালেন, ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিবাহ দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু তাই নয়, ২১ বছরের নিচে কোন ছেলের বিবাহ দেয়াও আইনে নিষিদ্ধ। এ ধরনের বিয়ে আয়োজনকারী বা বিয়েতে সহায়তাকারী অন্য কোন ব্যক্তিকেও কারাদণ্ড এবং জরিমানা করার বিধান রয়েছে। এর জন্য এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য জরিমানা বা উভয়বিধ শাস্তি হতে পারে। উল্লিখিত ঘটনাটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ভাগ্যবিড়ম্বনার অতি সাধারণ চিত্র। যুগ যুগ ধরে এটা নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া অপ্রতিরোধ্য সামাজিক সংস্কারের যেন এক চলমান প্রক্রিয়া। এটা শুধু নারীর জীবনেই অভিশাপ নয়, এর প্রভাব বিস্তৃত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রথমত, শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে নারী পরনির্ভরশীল জীবনে প্রবেশ করে। কৈশোর পার না হতেই অনেক মেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। অপূর্ণ শরীরে আরেকটি শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মায়েরই মৃত্যু ঘটে। রক্তস্বল্পতার কারণে অনেক প্রসূতি এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার যেমন বাড়ছে, তেমনি অপুষ্ট এবং খর্বকায় শিশুর জন্ম হচ্ছে। ফলে দাম্পত্য কলহ, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ, তালাক ও যৌতুক প্রদান এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। মমতার মা-বাবা শাস্তি থেকে বাঁচতে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে মেয়ের ১৮ বছর বয়সের সার্টিফিকেট দাখিল করে। কিন্তু কোর্ট এটা বাতিল করে দেয়। কারণ স্কুলের জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেটে মমতার বয়স পনেরো। এতে পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই, কারণ বর্তমানে প্রতিটি জন্মনিবন্ধন অনলাইনে এন্ট্রি করা হচ্ছে। বয়স পরিবর্তন করাও একটি অপরাধ। কিন্তু অনেকেই এ বিষয় না জেনে অল্পবয়সে মেয়ের বিবাহ দিচ্ছে। ফলে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাল্যবিবাহ নারীর স্বাভাবিক জীবনের পথে অন্তরায়। এটা নারীর ক্ষমতায়নেও প্রধান বাধা, যা জাতীয় উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যে আমরা একবিংশ শতাব্দিতে প্রবেশ করে উন্নয়নকামী দেশের কাতারে সামিল হয়েছি। উন্নত বিশ্বের সমান হওয়ার অনেক শর্তও এখন আমরা পূরণ করতে চলেছি। কিন্তু বাল্যবিবাহ এ শর্ত পূরণের অন্যতম প্রতিবন্ধক। এটা প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শতভাগ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে জন্ম সনদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে জন্মনিবন্ধন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী। বয়স পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এটা জানা দরকার ১৮ বছর বয়সের নিচের কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে ঘোষণা কিংবা সাক্ষ্য দিতে পারে না। এক্ষেত্রে অভিভাবকের পক্ষ থেকে সন্তানের বয়স পরিবর্তন বিষয়ে কোন ঘোষণা কার্যত বেআইনী। কিন্তু আমাদের অসচেতনতার কারণে অনেকেই নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এ কাজ করে যাচ্ছে। জন্ম সনদ একজন নাগরিকের মূল পরিচয়। জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে এটা তার সত্যতারও মাপকাঠি। অতীতের মতো নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে আর আমরা পিছিয়ে পড়তে চাই না। এতে শুধু নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় না বরং তার প্রভাব চলতে থাকে বংশপরম্পরায়। এজন্য অনলাইনে জন্ম সনদ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দাতা সংস্থার সহযোগিতায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে। ইতোমধ্যে ১৫ কোটিরও অধিক লোকের জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সমাজের প্রত্যেকেরই নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে ইউনিয়ন বিবাহ রেজিস্ট্রারদের দফতর স্থাপন করার সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা দরকার। স্কুলের শিক্ষকদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। নিয়মিত অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে। তাছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিবাহ রেজিস্ট্রি করা এবং বিবাহ রেজিস্ট্রি করার সময় কাজী অথবা পুরোহিতের অবশ্যই বর ও কনের বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরী। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অচিরেই এদেশে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হবেÑ এটাই প্রত্যাশা।
×