ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরে কেন যায়, সাগর দিয়ে কী করে যায়

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ জুন ২০১৫

সাগরে কেন যায়, সাগর দিয়ে কী করে যায়

সিডনির লাকেম্বা কার্যত এক খ- বাংলাদেশ! এটা প্রবাসী বাংলাদেশীদের বসতভিটা, বলা চলে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও। এই এলাকার নাম এখন হয়ে গেছে রোহিঙ্গা কর্নার! এখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধিক্য। এই মানুষগুলো বাংলাদেশী পরিচয়ে সাগরপথে অবৈধভাবে এদেশে আসছে। এভাবে অবৈধপথে বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। সংবাদটি রাষ্ট্র এবং মিডিয়ার অগোচরে হওয়ার কথা নয়। কক্সবাজার-টেকনাফ বেল্টের পুলিশ-প্রশাসন-গোয়েন্দা, র‌্যাব-বিজিবি-কোস্টগার্ড তারা করছে কি? আজ পড়ুন শেষ কিস্তি... বিদেশে মানব পাচার, অবৈধ যাত্রা ঠেকাতে সবার আগে যে কাজটা জরুরী তা হলো, এই তথ্যটি সবাইকে দিতে হবে, অবৈধভাবে বিদেশ তথা যে কোন দেশে যাওয়া মানে সে দেশের জেলে যাওয়া। আর বিদেশ যাবার মানে যদি দাঁড়ায় জেলে যাওয়া, তাহলে সেখানে যাবেন কেন? নানাদেশে যুদ্ধের কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে নৌকায় বা যে কোনভাবে বিদেশ যেতে চায়। আন্তর্জাতিক আইন-কানুনও তাদের সেভাবে মানবিক দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোন যুদ্ধ চলছে না। তাই এদেশ থেকে মানুষের নৌকায় করে বিদেশ যাত্রাকে কেউ মানবিকভাবে না, পাচার হিসেবে দেখে। এবার যত বাংলাদেশী নৌকায় বিদেশ যেতে গিয়ে ধরা পড়েছে, বিপদে পড়েছে, তাদের কিন্তু কারও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আশ্রয় হবে না। রোহিঙ্গাদের হবে। কারণ রোহিঙ্গারা সত্যিকারের শরণার্থী। কারণ তাদের দেশ তাদের স্বীকার করে না। আগে দালালরা নৌকায় অস্ট্রেলিয়া যাদের নিয়ে যেত তাদের মূলত নিয়ে যেত ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে। মাথাপিছু নেয়া হতো ১০-১৫ হাজার ডলার। আবার নৌকা ছাড়ার সময় হলে ১০০ ডলারের যাত্রী পেলেও তুলে নিত। এই নৌকা যেহেতু আর কোন দিন ফিরবে না, তাই পাচারকারীরা এমন নৌকা দিত যেটি মোটেই ভাল নয়। তাই পথে এসব নৌকা নানা সমস্যায় পড়তো। আগে অস্ট্রেলিয়ার নৌসীমায় এমন একটি নৌকা পৌঁছার পর এর অবৈধ যাত্রীদের আটক করে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী। অস্ট্রেলিয়ায় এদের নাম বোট পিপল। আগে এমন অবৈধ লোকজনকে ধরে ক্রিসমাস আইল্যান্ড নামের একটি দ্বীপের জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হতো। এখন আর এমন কাউকে ধরলে সেখানে নেয়া হয় না। নেয়া হয় পাপুয়া নিউগিনি, নাউরু এসব দেশের জেলখানায়। অস্ট্রেলিয়া সরকারের খরচে পরিচালিত এসব জেলখানায় রেখে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা হয় এরা সত্যি সত্যি শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে কিনা। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটিও করা হয় অস্ট্রেলিয়া সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে। বাংলাদেশ থেকে কেউ অস্ট্রেলিয়ায় এসে বলল দেশে তার জীবন বিপন্ন। সে বাঁচতে এখানে এসেছে। এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। এমনিতে মানবিক কল্যাণ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার আইনটি এমন যে, তার কাছে এসে যদি কেউ আশ্রয় চায় আর একভাগও যদি প্রমাণ করতে পারে যে, তার জীবন বিপন্ন, তাহলে এই রাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য। এভাবে প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় পায়। এভাবে অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়াকে কেন্দ্র করে এদেশে বিষয়টি এখন প্রশ্নকাতর রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁডিয়েছে। কারণ অভিবাসীদের পিছনে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে দেশটি। দেশটিতে গত লেবার সরকারের আমলে নৌকায় করে পঞ্চাশ হাজারের বেশি লোক এসেছে। গত নির্বাচনে অস্ট্রেলিয়ার লেবার সরকার যে হেরে গেছে এর জন্যে নৌকায় করে আসা বোট পিপল ইস্যুকে অন্যতম দায়ী মনে করা হয়। গত নির্বাচনে বিজয়ী টনি এবোটের নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল লিবারেল জোট ক্ষমতায় এসে বোট বন্ধ করার ব্যবস্থাপনাকে জোরদার করে। এর জন্যে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীর একজন ফোরস্টার জেনারেলের অধীনে সাগর পাহারায় গঠন করা হয়েছে নতুন একটা স্কোয়াড। সাধারণত কোন দেশে যুদ্ধ চলছে বা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সে দেশের সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, এমন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীরই অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় হতে পারে। সে হিসেবে বাংলাদেশের সাধারণ কারও অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার সুযোগ কম। বাংলাদেশের মানুষের অবৈধভাবে বিদেশযাত্রা ঠেকাতে শুধু সরকার না, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে। দেশটাকে নিরাপদ কাজের পরিবেশ অনুকূল করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সাধারণ মানুষের কাজের পরিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে মানুষ কাজ করতে পারে না। কাজ না করলে সে মজুরি পায় না। কাজের খোঁজে বেরিয়ে পেট্রোলবোমায় হতাহত হয়েছেন বিপুল মানুষ। বাংলাদেশের যে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ, সেখানে মানুষের কাজের পরিবেশ-নিরাপত্তা বিঘিœত হবার এসব নতুন উপসর্গ। অনেকে কাজ পাচ্ছেন, বেতন পাচ্ছেন না। বিদেশ সম্পর্কে নানা অবাস্তব গালগল্পও আমাদের দেশে বিস্তর প্রচলিত। বিদেশে গেলে ভাষার কারণেও যে আমাদের লোকজনের কাজ পাবার কত সমস্যা, এসব তারা জানেন না বা জানানো হয় না। ভাষাগত সমস্যার কারণেও যে অবৈধদের বিদেশে ধরা পড়ার ঝুঁকি পদে পদে, তা তাদের বেশি বেশি বলতে হবে। তাদের বলতে হবে, যে টাকায় তারা বিদেশ যেতে চান এর চেয়ে অনেক কম টাকায় দেশে পান-বিড়ির দোকান বা পিঠার দোকান দিয়ে অনেক বেশি রোজগার সম্ভব। কোন অবস্থাতেই কোন প্রলোভনে যাতে কেউ অবৈধপথে বিদেশ যাবার চেষ্টা না করেন। অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া মানে দালালের নৌকায় লাশ হওয়া। গণকবরের অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হতে বা বিদেশের জেলখানায় যেতে কেউ যাতে আর অবৈধভাবে বিদেশে যাবার চেষ্টা না করেন। লেখক : অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
×