ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ-নদী ভাঙ্গন

বছরে গৃহহারা ১ লাখ, বিলীন চার হাজার হেক্টর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১২ জুন ২০১৫

বছরে গৃহহারা ১ লাখ, বিলীন চার হাজার হেক্টর

শাহীন রহমান ॥ স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৭ হেক্টর এলাকা। এর বেশিরভাগই কৃষি জমি, বসতবাড়ি। এছাড়াও বছরের পর বছরে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে হাজার কিলোমিটার সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পাকা স্থাপনা। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশে সবচেয়ে ভাঙ্গনপ্রবণ বা বেশি ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে যমুনা নদী। এ সময়ের মধ্যে যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে দেশের ৯০ হাজার ৩৬৭ হেক্টর এলাকা। যমুনার পরেই রয়েছে পদ্মা নদীর স্থান। স্বাধীনতার পর এ নদীর ভাঙ্গনের শিকারের পরিণত হয়েছে ৩৩ হাজার ২২৯ হেক্টর ভূমি এলাকা। এছাড়াও গঙ্গা ও মেঘনার নদীর ভাঙ্গনে বিলিন হয়েছে যথাক্রমে ২৯ হাজার ৮৪১ হেক্টর ও ২৫ হাজার ৮২০ হেক্টর ভূমি। সেন্টার ফর ইনভাইরমমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদন নদীর ভাঙ্গনের ওপর এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম নদী ভাঙ্গন। প্রতি বর্ষা মৌসুম শুরু হলে ভাঙ্গনপ্রবণতা বেড়ে যায়। তা অব্যাহত থাকে শীত মৌসুম অবধি। (সিইজিআইএস) সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে চার হাজার হেক্টর এলাকা। আসছে বর্ষা মৌসুমের আগেই শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গ প্রক্রিয়ায়। তাদের মতে, নদী ভাঙ্গনের কারণে নদী পাড়ে মানুষের ২২ বার ঠিকানা পরিবর্তন করতে হয়। নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ লোক গৃহ হারা হয়ে নানা ধরনের সামাজিক বিপত্তির মুখে পতিত হচ্ছে। দেশের বড় বড় শহরের বস্তিতে বসবাসকারী লোকজনের বেশিরভাগই নদী ভাঙ্গনের শিকার। তবে তাদের মতে একটু সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া গেলে নদী ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব। বিশেজ্ঞদের মতে, নদী ভাঙ্গনে ক্ষয়ক্ষতি ধীরে ধীরে হলেও অন্যান্য আকস্মিক ও প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ অপেক্ষা অধিক ধংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। নদী ভাঙ্গনের বেশিরভাই প্রাকৃতিক কারণ সৃষ্ট। এর পাশাপাশি মানব সৃষ্ট কারণও প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। আগ থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে নদী ভাঙ্গন ও নদী ভাঙ্গন থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য নদী ভাঙ্গ রোধে আগাম পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রতিবছর যেসব এলাকা ভাঙ্গনের সম্ভাবনা রয়েছে সেসব এলাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে নদী ভাঙ্গনরোধে অবকাঠামো প্রতিরোধ গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য ব্যয়সাধ্য একটি বিষয়। এর চেয়ে নদীর ভাঙ্গন সম্পর্কে আগাম বা পূর্বাভাষ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে নদী ভাঙ্গনের ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে উল্লেখ করা হয়েছে নদী ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে পূর্ব সতর্ককতামূলক ব্যবস্থার কারণে ২০০৪ সাল থেকে যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা নদীতে ভাঙ্গনরোধে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ২০১২ সাল থেকে নিম্ন মেঘনা অববাহিকায় ইরোজন প্রিডিকশন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। তাদের মতে, নদী ভাঙ্গন সংক্রান্ত ভবিষ্যত বাণীর কারণে ২০১৪ সাল থেকে গঙ্গা ও পদ্মার মতো যমুনার নদীতে ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ২৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে প্রধান নদীগুলোর হলো গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা। এ চারটি নদীই সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙ্গনপ্রবণ নদী হলো যমুনা। এছাড়া মেঘনা, পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, মনু, জুরী, সাঙ্গু, ধলাই, গোমতী, মাতামুহুরি, মধুমতি, সন্ধ্যা, বিশখালী ইত্যাদি নদীও যথেষ্ট ভাঙ্গনপ্রবণ। দেশের এসব নদীর প্রায় ১৩০ স্থানে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যভাবে নদী ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটছে। যমুনা নদীর ভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে সিরাজগঞ্জ জেলা, গঙ্গায় কুষ্টিয়া জেলা, পদ্মায় শরীয়তপুর জেলা এবং নিম্ন প্রবাহিত মেঘনার শিকার হচ্ছে বরিশাল জেলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীরপাড় গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গনপ্রবণ হলো যমুনা নদী। সিইজিআইএসের সমীক্ষা প্রতিবেদনের দেখা গেছে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যমুনার করাল গ্রাসের শিকার হয়েছে দেশের ৯০ হাজার ৩৬৭ হেক্টর এলাকা। যমুনার ভাঙ্গনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা। প্রতিবছর যমুনা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ জেলা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে গঙ্গা নদীও যথেষ্ট ভাঙ্গনপ্রবণ। প্রতিবছর এ নদীর ভাঙ্গনের করাল গ্রাসের শিকার হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজবাড়ী জেলা। ১৯৭৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এ নদীর গর্ভের বিলীন হয়েছে ২৯ হাজার ৮৪১ হেক্টর এলাকা। তবে পদ্মা ভাঙ্গনের সবচেয়ে বেশি শিকার কুষ্টিয়া জেলা। যমুনার পরেই বেশি ভাঙ্গনপ্রবণ নদীর নাম পদ্মা। সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নদীর ভাঙ্গার শিকার হয়েছে ৩৩ হাজার ২২৯ হেক্টর ভূমি এলাকা। প্রতিবছর এ নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর শরীয়তপুর জেলা। বেশি ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে শরীয়তপুর জেলা। তবে অন্য তিন নদীর চেয়ে মেঘনা নদীর ভাঙ্গনপ্রবণতা কিছু হলেও কম। সমীক্ষা প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মেঘনার ভাঙ্গনে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে ২৫ হাজার ৮২০ হেক্টর এলাকা। এ নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে বরিশাল জেলা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদেশের বড় বড় নদীগুলোতে ভাঙ্গন স্বাভাবিক ঘটনা। নদী ভাঙ্গন এমন এক ধরনের দুর্যোগ যা মূলত আস্তে আস্তে ঘটে? ’৭০ ও ৮০-র দশক থেকে এদেশে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা যেমন বেড়েছে তেমনি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে অনেক। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অর্ধেকের বেশির পক্ষে টাকার অভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব হয় না। তারা পরিণত হয় গৃহহীন, ছিন্নমূল মানুষ। এ ধরনের গৃহহীন, ভূমিহারা মানুষেরা সাধারণত বাঁধ, রাস্তা, পরিত্যক্ত রেল সড়ক, খাসচর, খাস জমিতে ভাসমান জীবনযাপন করে। অনেকেই আবার কাজের খোঁজে শহরে চলে আসে। নদী ভাঙ্গনের কারণে তাই বেড়ে যাচ্ছে বেকারত্ব, নানা রকমের সামাজিক ও পারিবারিক সঙ্কট। সিইজিআইএসের নদী ভাঙ্গনের পূর্বভাসে বলা হয়েছে এ বছর দেশের তিনটি প্রধান নদীর ভাঙ্গনে ২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমি বিলীন হতে পারে। এতে গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়বে ২৬ হাজার ৯৪০ জন লোক। এ রিপোর্টে বলা হয়, শুধু যমুনা নদীতেই বিলীন হতে পারে ১৩৮০ হেক্টর জমি। এতে গৃহহীন ও ভূমিহীন হবে প্রায় ১৩ হাজার ৮২০ জন। এছাড়া গঙ্গায় বিলীন হতে পারে প্রায় ৪১০ হেক্টর জমি এবং পদ্মায় ৯০৫ হেক্টর জমি। সিইজিআইএস ২০০৪ সাল থেকে প্রতিবছর তারা নদীর তীর ভাঙ্গনের রিপোর্ট প্রকাশ করছে। উপগ্রহের ছবি, জিআইএস প্রযুক্তি এবং নদী ভাঙ্গনের ইতিহাস গবেষণা করে তারা এই রিপোর্ট তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদী ভাঙ্গনের এই পূর্বাভাস ধরে ব্যবস্থা নেয়া গেলে প্রতিবছর নদীর ভাঙ্গনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর সম্ভব হবে। প্রতিবছর নদীর ভাঙ্গন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেন, যমুনা নদীর তীর রক্ষায় সরকার একটি মেগা প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ১৬০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষায় ব্যয় হবে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। তিনি জানান, যমুনা খুবই জটিল একটি নদী। তাই তীর ভাঙ্গনে এই নদী পাড়ের মানুষের ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশি। এই প্রজেক্ট বাস্তাবায়িত হলে নদী পাড়ের মানুষ রেহাই পাবে।
×